অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এফডিআই’র ভূমিকা

. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা

(গতকালের পর)

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিংস: বাংলাদেশ বর্তমানে বৈদেশিক বাণিজ্য ও রিজার্ভ নিয়ে বেশ চাপে আছে। বাংলাদেশের আর্থিক কাঠামোর ক্রেডিট রেটিং করে থাকে বিশ্বের প্রভাবশালী কিছু আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং সংস্থা। তাদের মধ্য থেকে বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনটি প্রতিষ্ঠান হলোÑমুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিংস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই তিন প্রতিষ্ঠানের ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর কোনো দেশের অর্থনীতির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই নির্ভর করে। এসঅ্যান্ডপি, মুডিস ও ফিচ রেটিংসÑএই তিন প্রতিষ্ঠানকে সম্মিলিতভাবে বিগ-থ্রি বলা হয়। ঋণমান নির্ণয়ে এই তিন সংস্থাকে বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান মনে করা হয়।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যে এ তিন প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঋণমান ও অর্থনৈতিক পূর্বাভাসের প্রভাব পড়ে। চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’ এতে নামিয়ে দেয় মুডিস। (সূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা, ২৫ জুলাই ২০২৩)

গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশ-সংক্রান্ত ঋণমান আভাস বা রেটিং আউটলুক কমিয়েছে। তখন তারা বাংলাদেশের ঋণমানের অবস্থা স্থিতিশীল থেকে ‘নেতিবাচক’ ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বভৌম ঋণমান দীর্ঘ মেয়াদে ‘বিবি মাইনাস’ ও স্বল্প মেয়াদে ‘বি’ বলে নিশ্চিত করেছে এসঅ্যান্ডপি। এসঅ্যান্ডপি বলেছিল, স্বল্প মেয়াদে বিদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশের সরকারের যে অর্থ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা আছে, তার অবস্থা আগামী বছর আরও খারাপ হতে পারে। এর ওপর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ চাপের মুখে আছে। মূলত এ দুই কারণে বাংলাদেশ-বিষয়ক পূর্বাভাস হ্রাস করে এসঅ্যান্ডপি। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের ঋণমান কমার আভাস দিয়েছে। সংস্থাটি বাংলাদেশ বিষয়ক ঋণমান আভাস বা রেটিং আউটলুক কমিয়ে নেতিবাচক করেছে। আগে এই আউটলুক ছিল স্থিতিশীল। প্রকাশিত প্রতিবেদনে রিজার্ভের পতন ও ডলার সংকটকে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ফিচ রেটিংস বাংলাদেশের  আইডিআর (লং টার্ম ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং) রেটিং করেছে বিবি মাইনাস। (সূত্র: দৈনিক বণিক বার্তা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

মোট পুঞ্জীভূত (স্টক) ও নিট এফডিআই প্রবৃদ্ধি: বাংলাদেশে বেসরকারি বিভিন্ন খাতে সরাসরি যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন করে বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ থেকে মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর অবশিষ্ট অঙ্ককে নিট বিদেশি বিনিয়োগ বলে। বাংলাদেশে প্রকৃত প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত ষাণ¥াসিক এন্টারপ্রাইজ সার্ভের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়ে থাকে। নিন্মে মোট পুঞ্জীভূত (স্টক) ও নিট এফডিআইয়ের প্রবৃদ্ধি তুলে ধরা হলো।

টেবিল-২

১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এফডিআইয়ের প্রবৃদ্ধি (কোটি মার্কিন ডলার)

টেবিল-২ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৯৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ২৩ বছরে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) মোট পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৯২৬ দশমিক ৭৬ কোটি ডলার। প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮৩ দশমিক ৭৭ কোটি ডলার। নিট এফডিআইয়ের মোট প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩১৭ দশমিক ০৮ কোট ডলার। প্রতি বছর গড়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৯ কোটি ডলার। এই ২৩ বছরে মোট পুঞ্জীভূত (ঝঃড়পশ) এফডিআইয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে একবার ২০২২ সালে ৪২ দশমিক ৩৭ কোটি ডলার। এর মানে হলো বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের অর্জিত মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নিট এফডিআইয়ের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ বার, যার পরিমাণ ২০৬ দশমিক ৮২ কোটি মার্কিন ডলার। আর ধনাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ বার, যার পরিমাণ ৫২৫ দশমিক ৭১ কোটি মার্কিন ডলার। অতএব, নিট এফডিআইয়ের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ৭৯ কোটি মার্কিন ডলার। এর মানে হলো বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্বিপাকে এবং দেশে উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকা। দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রধান তিনটি উপাদান হলো রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও এফডিআই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে এফডিআই। সুতরাং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ও স্থিতিশীল আর্থিক কাঠামো গড়ে তুলতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোকল্পে গৃহীত সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।

টেবিল-৩

২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এফডিআই প্রবাহ

(কোটি মার্কিন ডলার)

টেবিল-৩ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ৯ বছরে মোট এফডিআই প্রবাহ ছিল ৩,০৮৯ দশমিক ৫৪ কোটি ডলার। আর এই সময়ে মোট বহিঃপ্রবাহ (উরংরহাবংঃসবহঃ) ছিল ৭২২ দশমিক ২৭ কোটি ডলার।

এফডিআই বিনিয়োগে উত্থান-পতনের কারণ: বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রধান সমস্যা হলো ব্র্যান্ডিং। বন্দরের সমস্যা অন্যতম। ডলার সংকট এরই মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অবমূল্যায়ন এফডিআই স্টক কমে যাওয়ার কারণ। আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী শীর্ষ তিনটি সংস্থা মুডিস, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিং সম্প্রতি বাংলাদেশের ঋণমান নেতিবাচক করেছে। ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা আস্থার সংকটে পড়েছে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাক্সিক্ষত মানের বিনিয়োগ করাও একটি অন্যতম কারণ। এ দেশের একশ্রেণির ব্যবসায়ী ব্যবসার নামে বিদেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করছে। এর ফলে আমাদের অর্থনীতির ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। দৈনিক বণিক বার্তা ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে আন্তর্জাতিক পণ্য বাণিজ্যে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ কমপক্ষে ১৫ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স হিসেবে আসছে আরও ১০ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দুর্নীতি ও কালোবাজারির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ পাচার, স্বর্ণ ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালান, মানব পাচারের মতো কার্যক্রমে হুন্ডি-হাওলার অবদান ৫ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার। দেশের জনশক্তিকে সেক্টরভিত্তিক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, আইনের প্রয়োগ, স্বেচ্ছাচারিতা ও ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিতে বাধা অন্যতম। বিদেশি পাওনা পরিশোধে অদক্ষতা, বিভিন্ন ব্যাংকের ডলার সংকটÑএ সবকিছু বিদেশি বিনিয়োগের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে।

উপসংহার: স্বাধীনতার পর থেকে দেশের আর্থসামাজিক, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বৈদেশিক বিনিয়োগ। অর্থনীতির সূত্র হলো, দেশি বিনিয়োগ বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। কারণ দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে তারল্য সংকট দূর করতে হবে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ সালে আমরা উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। এই অবস্থায় অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সব সমন্বয়হীনতা ও আমতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীলতায় আনতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কর্তৃক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২১’ বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০২১ সালের ২৮ ও ২৯ নভেম্বর। ওই সম্মেলনে বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণকারীরা বিদেশি বিনিয়োগ বিকাশে জরুরি পরামর্শ প্রদান করেন, যার ভিত্তিতে ২৪টি সংস্কারমূলক সুপারিশ প্রস্তুত করে বিডা। অবকাঠামো খাতে সাতটি, আর্থিক খাত এবং পুঁজিবাজার খাতে ৯টি, সেবা খাতে দুটি, ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে তিনটি এবং সাধারণ হিসেবে তিনটি সুপারিশমালা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট জিডিপির আকার ছিল ৪৬০ বিলিয়ন ডলার আর নিট বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে জিডিপিতে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান শূন্য দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের এফডিআই যদি পাঁচ-ছয় শতাংশে উন্নীত করা যায়, তাহলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ১০ শতাংশ। 

বাংলাদেশের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধির উপায় হলো দক্ষ জনশক্তি তৈরি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা হ্রাস। বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রধান উপাদান হলো সস্তা শ্রম। কিন্তু এখন শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে খুব বেশি বিনিয়োগ আনা যাবে না। সে জন্য তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। একই সঙ্গে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি, উন্নত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, যেসব শিল্প দেশের পুঁজি বাড়াবে এবং অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থাপনা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামি অর্থনীতির সম্প্রসারণ। [শেষ]

কর্মকর্তা

শরিয়াহ্ সেক্রেটারিয়েট

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি

drmdgulammustafa@gmail.com