নিজস্ব প্রতিবেদক: বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সংকট বিরাজমান। এ সংকট এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। সংকট কাটিয়ে উঠতে বড় ধরনের সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সেই সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মসূচির মাধ্যমে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় ধরনের কোনো সংস্কার হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। নির্বাচনের পরেও এ সংস্কার কতটা হবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। আর অর্থনৈতিক এ সংকটকে আরও বেশি ঘনীভূত করে তুলছে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। তাছাড়া এবার রাজনৈতিক বিষয়টির সঙ্গে বিদেশিরাও যুক্ত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী দিনে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)।
রাজধানীর বনানীতে গতকাল সংগঠনটির নিজ কার্যালয়ে ‘আইএমএফ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. এমএ রাজ্জাক।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের সময় বিদেশি সম্পৃক্ততা তেমন ছিল না, এবার আছে। এ বছর অন্য দুবারের মতো নির্বাচন হবে না। নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। নির্বাচনের পরও যে শান্তিতে থাকব, সে কথাও বলা যাচ্ছে না।’
তিনি উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি এবার আরও নতুন কিছু ইস্যু এসেছে। যেমন শ্রম ইস্যু বড় হয়ে গেছে। এটির এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। শ্রম পরিবেশ ঠিক করতেই হবে। মানবাধিকার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। এসব বিষয়ে জবাবদিহি বাড়াতে হবে, কিন্তু এক্ষেত্রে অতীত রেকর্ড ভালো নয়। কেননা এখনও ভিন্ন মত প্রদানকারী ও বিরোধী
রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা আটক রয়েছেন। এক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করতে হবে। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অর্থনীতির বাইরের নানা চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, যা অর্থনীতিকে আরও চাপে ফেলছে।’ এ বিষয়ে একটি রূপক উদাহরণ দেন তিনি। আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘খারাপ পরিবেশে ছেড়ে দিলে ছেলে তো বখাটে হবেই।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে দেশে রিজার্ভের একটি বড় সংকট চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এটিকে হয়তো ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলারে ধরে রাখতে চাইবে। তবে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে ভারত, চীন, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জরুরি ভিত্তিতে চার বিলিয়ন ডলার ধার নিয়ে রিজার্ভ বাড়ানো যেতে পারে।’ গত বছর শ্রীলঙ্কা যখন অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল, তখন তারা ভারত, বাংলাদেশসহ বেশকিছু দেশ থেকে এভাবে অর্থ ধার নিয়েছিল। বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওইরকম কোনো পরিস্থিতি যাতে না ঘটে, সেজন্যই প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ ও শর্ত, সংস্কারÑএসব বিষয় উঠে আসে। পিআরআই মনে করে, এবারই প্রথমবারের মতো রাজনীতি ও অর্থনীতিÑদুই বিষয়েই একই সঙ্গে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, বিনিময় হারÑএসব নিয়ে চাপে আছে অর্থনীতি। আইএমএফ এসব বিষয়ে সংস্কার করতে বলেছে। কিন্তু নির্বাচনের আগে এসব সংস্কার করা সম্ভব নয়। তাই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশেই থাকবে। বিনিময় হার কোথায় ঠেকবে বলা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পরেও যে এসব সংস্কার হবে, সেই দিকনির্দেশনাও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে বড় ধরনের সংস্কার করতেই হবে।’
তিনি বলেন, ‘আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পেতে বড় কোনো সমস্যা হবে না, যদি বৃহৎ শক্তিধর দেশ বাধা না দেয়।’ এ বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর একটি উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ‘আমি আইএমএফের মিশন-প্রধান হিসেবে সুদান সফরে গিয়েছিলাম। সুদান তখন আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির মধ্যে ছিল। তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছিল না। তখন আমরা বলেছি, তাদের ঋণের কিস্তি আপাতত পরিশোধ করতে হবে না, শুধু সংস্কার করলেই হবে। এমন প্রস্তাব আইএমএফের বোর্ডে ওঠার আগের রাতে জি-১০ এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়। শেষ পর্যন্ত সেই প্রস্তাব পাস হয়নি।’
মূল বক্তব্যে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইএমএফের দেয়া বেশ কিছু শর্ত পরিপালন করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবুও কিছু শর্ত শিথিল করা হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রতিনিধিদলের সফরে একটি স্টাফ লেভেল এগ্রিমেন্ট হয়েছে। বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতি মূল্যায়ন করে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আইএমএফ ইতিবাচক রয়েছে। কিন্তু আমেরিকার মতো পরাশক্তি চাইলে এতে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এর আগেও অন্যদেশে এমন হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল বলে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন ড. মনসুর। আইএমএফের সাবেক এ কর্মকর্তা নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, বোর্ড সভার অনুমোদন থাকার পরও সুদানের একটি ঋণ চুক্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।