ইসমাইল আলী: অর্থনৈতিক সংকট গত অর্থবছর শুরু থেকেই প্রকট হতে থাকে। একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে গিয়ে ভোগ ব্যয় কমাতে বাধ্য হয় মানুষ। অন্যদিকে ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। পাশাপাশি টাকার অবমূল্যায়ন আর তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিনিয়োগ পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
করোনার ধাক্কা সামাল দিয়ে পরপর দুই অর্থবছর আমদানি-রপ্তানি ছিল ঊর্ধ্বমুখী ধারায়। তবে গত অর্থবছর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক পর্যায়ে পৌঁছায়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতেও নামে ধস। সব মিলিয়ে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ অনুৎসাহিত হয়েছে। আবার কৃচ্ছ সাধন নীতির কারণে সরকারি বিনিয়োগেও হয়েছে বড় ধরনের পতন। সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র খুবই মলিন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মূল্যায়নে এ চিত্র উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে বাংলাদেশের জন্য ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি অনুমোদন করেছে সংস্থাটি। এ-সংক্রান্ত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল্যায়নের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে; যা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলোর দুর্বল অবস্থান নির্দেশ করছে। ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছে আইএমএফ। পাশাপাশি ২০২২-২৩ অর্থবছরের সূচকগুলো প্রাক্কলিত চিত্র এবং চলতি অর্থবছরসহ আগামী কয়েক বছরের জন্য প্রক্ষেপণও তুলে ধরেছে সংস্থাটি।
আইএমএফের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছর তা ৬ শতাংশে নামে। চলতি অর্থবছরও তা ৬ শতাংশই থাকবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাথমিক হিসাবেও গত অর্থবছর জিডিপির হার ৬ শতাংশই তুলে ধরা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের জন্য গত জুনে বাজেটে সাড়ে সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও, সম্প্রতি তা কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ আইএমএফের প্রাক্কলন ও সরকারের হিসাব প্রায় একই ধরনের চিত্র নির্দেশ করছে।
গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিপরীত চিত্র ছিল মূল্যস্ফীতিতে। ২০২২-২৩ অর্থবছর বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে ঠেকেছে বলে প্রাক্কলন করেছে আইএমএফ। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর তা ছিল ৬ দশমিক ১ শতাংশ। চলতি অর্থবছর বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ দাঁড়াতে পারে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ছয় শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও, বাজেট সংশোধনের শুরুতে তা বাড়িয়ে সাত শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
সূত্রমতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ধরা হয় ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়কে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯০’র দশকে উš§ুক্ত করে দেয়ার পর ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয় দেশের অর্থনীতিকে ৬৫-৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে অর্ধেক বা তার বেশি ছিল ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি। তবে গত অর্থবছরের মতো পরিস্থিতি সাধারণত দেখা যায় না। করোনার পর গত অর্থবছর ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধি ছিল কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, যা উদ্বেগজনক।
২০২২-২৩ অর্থবছর ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অথচ তার আগের অর্থবছর (২০২১-২২) এ হার ছিল সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয় প্রবৃদ্ধি অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রেমিট্যান্সের প্রবাহে ধীরগতি, সরকারি বিনিয়োগ হ্রাস এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশেজ্ঞরা। তবে চলতি অর্থবছর ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে আইএমএফ।
ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ের বিপরীত চিত্র দেখা গেছে গত অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছর সরকারের ভোগ ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। গত অর্থবছর তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। নির্বাচনের আগের বছর নানা খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এটি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চলতি অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি আবার কমে দাঁড়াবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
গত অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ের বিপরীত চিত্র ছিল সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। ২০২১-২২ অর্থবছর সরকারি বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ। গত অর্থবছর তা প্রায় অর্ধেকে নামে। এ সময় সরকারি বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। সরকারের কৃচ্ছ সাধন নীতির জন্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে ধীরগতি, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ ছাড়ে ধীরগতি ইত্যাদি কারণে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। তবে চলতি অর্থবছর নির্বাচনের কারণে জনসন্তুষ্টি অর্জনে আবারও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা হবে বলে মনে করছে আইএমএফ। এতে চলতি অর্থবছর সরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ১২ দশমিক ১ শতাংশ।
অন্যদিকে ব্যক্তিখাতের ভোগ ব্যয়ের মতোই ব্যক্তি বিনিয়োগেও ধস নামে গত অর্থবছর। ২০২১-২২ অর্থবছর এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছর তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি সাত ভাগের এক ভাগে নামে। চলতি অর্থবছর ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
ব্যক্তি ও সরকারি উভয় বিনিয়োগের উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রভাবে ২০২১-২২ অর্থবছর সার্বিক বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ডাবল ডিজিটের (দুই অঙ্ক)। ওই অর্থবছর সার্বিক বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে ধস নামায় গত অর্থবছর সার্বিক বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছর তা আবার বেড়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অন্যতম। ২০২১-২২ অর্থবছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল রেকর্ড ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে গত অর্থবছর তা মাত্র ১০ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসে। চলতি অর্থবছরও এ খাতে প্রবৃদ্ধি খুব একটা বাড়ার আশা করছে না আইএমএফ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানিতে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর রপ্তানির মতো আমদানিতেও রেকর্ড ৩১ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। যদিও আমদানি প্রবৃদ্ধির এ হারকে অস্বাভাবিক মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এক্ষেত্রে আমদানির অর্থ পাচার হয়ে থাকতে পারে বলেও তারা বিভিন্ন সময় সংশয় প্রকাশ করেছেন। তবে গত অর্থবছর সরকার আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি এলসি খোলায় যাচাই-বাছাই শুরু করা হয়। এর ধাক্কায় ২০২২-২৩ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে পড়ে।
করোনার পর গত অর্থবছরই আমদানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়, যা ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরও ডলার সংকটের কারণে আমদানি পুরোপুরি উš§ুক্ত করে দেয়নি সরকার। এছাড়া টাকার অবমূল্যায়নে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি চার শতাংশ দাঁড়াবে বলে প্রক্ষেপণ করেছে আইএমএফ।
আগামী অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। তবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের পতনের আশঙ্কা করা হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছর তা চার শতাংশের নিচে নেমে যেতে পারে। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে স্বস্তির চিত্র ফিরতে আরও এক থেকে দুই বছর লেগে যেতে পারে বলেই পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।