রোকাইয়া মাহজাবিন: প্রাচীনকালে মানবসভ্যতা গড়ে উঠেছিল নদীকে কেন্দ্র করে। এর প্রধান কারণ কৃষিকাজ। আদিম মানুষ যখন কৃষিকাজের ধারণা পেল তখন তারা অনুভব করল পানির প্রয়োজন। আর তখন থেকেই মানবসভ্যতা গড়ে উঠতে শুরু করল নদীকে কেন্দ্র করে। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মানবসভ্যতার প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ। কৃষিকাজ বাংলাদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা। দেশের শতকরা ৭০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষি বাংলার মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
কৃষিকাজ করে দেশের হাজার হাজার কৃষক তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম উজাড় করে উৎপাদন করে ধান, গম, পাট, তিল, তিসিসহ নানা রকম সবজি। ফসলের মাঠের সোনার ফসলে লেগে থাকে কৃষকের ভালোবাসা এবং দিনরাত একাকার করে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানোর প্রতিচ্ছবি। কি বৃষ্টি, কি ঝড়ে ফসলের মাঠ তাদের সঙ্গী। একটি ঘরে আনার পর কৃষকের মনে আঁকতে থাকে আরেকটি ফসলের ছবি। এভাবেই তারা সারাবছর গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের জন্য ফসল উৎপাদন করে।
কৃষকের উৎপাদিত ফসল পাট আমাদের অর্থকরী ফসল। যাকে আমরা সোনালি আঁশ হিসেবেও চিনি। পাটের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত প্রতিটি অংশই আমরা ব্যবহার করতে পারি। পাটশাক অত্যন্ত উপকারী ও উপাদেয়। কমবেশি সব মানুষই এটা পছন্দ করে। তেমনি করে পাটকাঠি প্রতিটি বাঙালি নারীর রান্নাঘরে নিত্যদিনের জ্বালানি। গ্রামগঞ্জে ঘরের বেড়া ও ছাউনিতে এটা ব্যবহার করা হয়। আধুনিক যুগে পাটকাঠির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ করা যায় পার্টিকেল বোর্ডের আসবাব তৈরিতে। অন্যদিকে যে জিনিসটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পাটের আঁশ। পাটের আঁশের নানামুখী ব্যবহার রয়েছে, যেমন পাটের ব্যাগ, মোড়া, ঘর সাজানোর উপাদান ইত্যাদি। পাটের তৈরি জিনিস পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। পরিবেশ রক্ষায় পাট সন্দেহাতীতভাবে আমাদের অনেক বড় অর্জন। পাটের চাহিদা বিদেশে অনেক বেশি। তাই আমরা যদি পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করে পাটের উৎপাদন বাড়াতে পারি, তাহলে বাড়তি পাট বিদেশে রপ্তানি করে আমরা অর্জন করতে পারি বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে পাট উৎপাদন দিন দিন কমে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে কৃষকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজ উপাদান হলো আখ। আখ কমবেশি আমাদের সবার কাছে পরিচিত। আখের রস সুপরিচিত ও সুপেয় পানীয়। আখের তৈরি গুড় ও চিনি না হলে আমাদের এক দিনও যেন চলে না। আখ উৎপাদন করা হয় সাধারণত বালুমাটিতে। আমরা আখ উৎপাদনে সম্ভাবনাময় দেশ। অথচ প্রতিবছর অন্য দেশ থেকে বিশেষ করে ভারত থেকে আমদানি করি কোটি কোটি টাকার চিনি। এককালে আমরা নাকি চিনি উৎপাদনে ছিলাম সেরা। বর্তমানে আখ চাষের সেরা সময় আমরা হারিয়েছি। এখন প্রতি বছর চিনির জন্য চেয়ে থাকতে হয় অন্য দেশের দিকে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশের সুগার মিল করপোরেশন চালু হয়। সে সময় দেশে ৭২টি চিনিকল ছিল, যার মধ্যে ৫৯টি চিনিকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ১৫টি চিনিকল, যার মধ্যে ছয়টি চিনিকল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। তার মানে চিনি উৎপাদন চলবে মাত্র ৯টিতে। উৎপাদিত চিনি ১৭ কোটি মানুষের জন্য অতি সামান্য। এতে দেখা দেবে ঘাটতি এবং প্রতি বছর অন্য দেশ থেকে চিনি আমদানি করতে হবে। এতে করে আমাদের দেশের কষ্টার্জিত টাকা চলে যাবে অন্য দেশের হাতে।
আমাদের অর্থকরী ফসল পাট ও আখসহ আরও যে কৃষিজ উপাদান রয়েছে, সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে, যদি আমরা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে চাই। আখ ও পাট দেশের অর্থনীতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ফসল, যা আমরা হেলায় হারাচ্ছি। আখ সাধারণত উৎপাদিত হয়ে থাকে বালুমাটিতে এবং পাট উৎপাদিত হয় নদীকেন্দ্রিক অঞ্চলে। বালুময় মাটি ও নদী একত্রে আমরা পেয়ে থাকি চরাঞ্চলে। তাই দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে আমাদের আগে বাঁচাতে হবে চরাঞ্চলকে।
বাংলাদেশের ৭০০টিরও বেশি অসংখ্য নদী রয়েছে। এসব নদীর বুকে জেগে ওঠে ছোট-বড় অসংখ্য চর। চরাঞ্চলে বিভিন্ন রকমের মাটি থাকে,, যার কারণে সেখানে উৎপাদিত হয় হরেক রকমের ফসল। চরের মানুষ দিনরাত এক করে কাঠফাটা রোদে পুড়ে উৎপাদন করে এসব ফসল। চরাঞ্চলে সাধারণত সারাবছর চলে ফসল উৎপাদনের কাজ। তাই বলা যায়, তারাই মূলত দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার প্রধান চালিকাশক্তি। সেজন্য তাদের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। চর জেগে ওঠে নদীর বুকে এবং সেখানে উৎপাদিত হয় ফসল। ফসল মাড়াই করা শেষে সেগুলো বিক্রি করার সময় চরাঞ্চলের মানুষ পড়ে চরম ভোগান্তিতে। নদীতে নৌকাযোগে তাদের ফসল বাজারে আনতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে। কিন্তু তারা তাদের ন্যায্যমূল্য পায় না, যার কারণে কাটে না তাদের দুঃখ-কষ্ট। চরাঞ্চলে মানুষের ফসল উৎপাদনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা নদীকেন্দ্রিক জটিলতা। নদীর বুকে সামান্য চরে চলে তাদের ফসল উৎপাদনের কাজ। মাটির বুক চিরে মাঠে ফসলের সোনালি হাসি ফুটলেও হাসি ফোটে না কেবল চরের মানুষের মুখে। তাদের সব সময় শঙ্কায় কাটাতে হয়। এর বিশেষ কারণ নদীভাঙন ও বন্যা, যা বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। চরের মানুষ তাদের সবটুকু দিয়ে স্বপ্নে আঘাত হানে। নদীভাঙনের ফলে যে কেবল তারা ফসল হারায় তা নয়, তাদের হারাতে হয় ঘরবাড়িও। এই নদীভাঙন রোধ করার জন্য প্রয়োজন যথাযথ ব্যবস্থা। নদীর পাড় বাঁধাই করা সম্ভব হলে চরাঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি ও দুশ্চিন্তা কমবে। এছাড়া সরকারের বিশেষ নজর দেয়া উচিত চরের মানুষের ন্যূনতম শিক্ষার দিকে। কারণ যথাযথ শিক্ষার অভাবে তারা তাদের ফসলের পরিচর্যার ব্যাপারে কম অভিহিত। শিক্ষার হার বাড়লে তারা নিজেরাই নিজেদের উন্নত করতে পারবে তাদের অঞ্চলকে। এছাড়া খেয়াল রাখতে হবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য, নদীভাঙন এবং উপযুক্ত শিক্ষার দিকে। এসবের করণেই চরাঞ্চলের মানুষ পিছিয়ে রয়েছে। এছাড়া কৃষক কিছু অর্থকরী ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে ন্যায্য দাম না পেয়ে। দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে চরাঞ্চলের বিকল্প নেই। আর সেজন্য দরকার চরাঞ্চলের উন্নয়ন এবং উন্নয়নের জন্য দরকার সরকারের বিশেষ দৃষ্টি।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়