শেখ শাফায়াত হোসেন: ‘খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না’অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এমন ঘোষণা বাস্তবে রূপ না নিয়ে তা উল্টো ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেল। এর ফলে গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে শ্রেণিকৃত ঋণ দাঁড়াল এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকায়, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত মার্চে দেশের ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের স্থিতি ছিল ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা।
শ্রেণিকৃত ঋণবিষয়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা, যা ছিল ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
এর আগে সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ অবশ্য কিছুটা বেশি ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা।
গত ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। মন্ত্রিসভার রদবদলে আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্থলাভিষিক্ত হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এসেই দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে শুরু করেন তিনি।
গত ১০ জানুয়ারি বেসরকারি ব্যাংক মালিক ও প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলন করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। তাই বলছি, আজকের পর থেকে খেলাপি ঋণ বাড়বে না ইনশাল্লাহ।’
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকের শ্রেণিকৃত ঋণের তথ্য চূড়ান্ত করে। তখন দেখা যায়, খেলাপি ঋণ পাঁচ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা কমেছে।
অবশ্য ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমে আসার একটি ব্যাখ্যা আগেই দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বর ও জুনে ব্যাংকের বার্ষিক ও ষাণ¥াসিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের একটি বিষয় থাকে। এ কারণে ব্যাংকের অবস্থা ভালো দেখাতে অনেক ব্যাংক এ দুই সময়ে এসে ঋণ ব্যবস্থাপনা জোরদার করায় খেলাপি ঋণ কমে আসে। মার্চ ও সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আবার বাড়ে।
তবে এবার মার্চ শেষে খেলাপি ঋণে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত ১৬ মে জারি করা ঋণখেলাপিদের মাত্র দুই শতাংশ এককালীন নগদ জমাসাপেক্ষে (ডাউন পেমেন্ট) সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট বা সম্পূর্ণরূপে পরিশোধের বিশেষ সুবিধার নীতিমালা বাস্তবায়ন উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় স্থগিত না থাকলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমে আসত।
গত ২৪ মে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা সার্কুলারের ওপর আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেন হাইকোর্ট।
গতকাল ২০১৯ সালের প্রথম প্রান্তিকের শ্রেণিকৃত ঋণসংক্রান্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল)। মার্চ শেষে এ ছয়টি ব্যাংকে এক লাখ ৬৭ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার মধ্যে ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকাই ছিল শ্রেণিকৃত ঋণ। অর্থাৎ বিতরণ করা ঋণের ৩২ দশমিক ২০ শতাংশই খেলাপি ঋণ।
বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৪৯ হাজার ৯৪৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা এ খাতের ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের সাত দশমিক শূন্য আট শতাংশ।
এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা, যা এ দুটি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শ্রেণিকৃত ঋণ রয়েছে দুই হাজার ২৫৬ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা ঋণের ছয় দশমিক ২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে রাইট-অফ বা অবলোপনকৃত খেলাপি ঋণের স্থিতি ছিল ৩৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। শ্রেণিকৃত ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা খেলাপি ঋণের স্থিতি যোগ করলে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৫০ হাজার ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকায়।
প্রসঙ্গত, খেলাপি ঋণের মধ্যে আদায় অযোগ্য কিছু ঋণ নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করে ব্যালেন্সশিট থেকে বাদ দেওয়ার একটি স্বীকৃত পদ্ধতি ঋণ অবলোপন। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ অবলোপন নীতিমালাও কিছুটা শিথিল করে। এতে আগে যেখানে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ অবলোপন করা যেত, সেখানে দুই লাখ টাকা করা হয় এবং পাঁচ বছরের পুরনো ঋণের পরিবর্তে তিন বছরের পুরোনো ঋণও অবলোপন করার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে অবলোপন করা ঋণ বেড়ে যায় প্রায় ৫০৩ কোটি টাকা।
মার্চে খেলাপি ঋণ অসম্ভব রকম বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এমনিতেই ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকের তুলনায় মার্চ ত্রৈমাসিকে খেলাপি ঋণ বাড়ে। আশা করছি, জুনে খেলাপি ঋণ অনেকটা কমে আসবে। তবে আমরা যে লক্ষ্য নিয়েছিলাম, তাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমতো। তারপরও আমরা ব্যাংকগুলোকে বলবÑঋণ আদায় জোরদারের পাশাপাশি নতুন ঋণ বিতরণ করতে পারলে খেলাপি ঋণের হার দুই অঙ্ক থেকে এক অঙ্কে নামিয়ে আনা কঠিন হবে না।’
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে মার্চে ১৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ বাড়ায় কপালে ভাঁজ পড়ছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। তাছাড়া অতীতের যে কোনো সময় থেকেও এখন খেলাপি ঋণের হার অনেক বেড়ে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠে এসেছে। কয়েক বছরে খেলাপি ঋণের হারও এত বাড়তে দেখা যায়নি।
