রহমত রহমান: তৈরি করা ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাগের ওপর সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বা কেনাকাটার ওপর পরিশোধ করা হয়নি উৎসে ভ্যাট। নেয়া হয়েছে অতিরিক্ত রেয়াত, কেনা হয়েছে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল। সিমেন্টসহ অন্যান্য ব্যাগ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অলিম্পিক ফাইবার লিমিটেডের এমন কয়েকটি খাতে সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। খুলনা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের নিরীক্ষায় এই ফাঁকি উঠে এসেছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানকে ফাঁকি দেয়া ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধে দাবিনামা জারি করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, অলিম্পিক ফাইবার নামের প্রতিষ্ঠানটি বরিশালের রূপাতলীতে অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি সিমেন্ট ব্যাগ ও সুইং ব্যাগসহ বিভিন্ন ব্যাগ উৎপাদন করে থাকে। যার মূল উপকরণ পিপি ইয়ার্ন গ্রেড, পিপি কো-পলিমার, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, ক্রাফ্ট লাইনার পেপার, মাস্টার ব্যাচ, প্রিন্টিং কালি, থিনার, সুতা, গ্লু এবং প্যাকিং ম্যাটেরিয়াল প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করে থাকে। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটির রেয়াত ও উৎসে মূসক বা ভ্যাট সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত যাচাই করা হয়। এতে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি উঠে আসে।
নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হতে কাঁচামাল ক্রয় বাবদ ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২৩ টাকা, নিরীক্ষাধীন সময়ে মূল্য ঘোষণায় প্রতি একক উৎপাদনে ব্যবহƒত উপকরণ এবং বিক্রয় রেজিস্ট্রারে প্রদর্শিত মোট উৎপাদনের বিপরীতে ক্রয় রেজিস্ট্রারে ব্যবহƒত উপকরণে ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ৮১২ টাকা। ওই একই সময়ে সরবরাহ মূল্যের বিপরীতে অপরিশোধিত ৬৮ লাখ ১৩ হাজার ২৭৫ টাকার সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বা ভাট বাবদ ১০ লাখ ২১ হাজার ৯৯১ টাকাসহ ফাঁকিকৃত শুল্ক ও ভ্যাটের পরিমাণ মোট ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৬ টাকা।
উল্লেখ্য, মূসক আইন অনুযায়ী, পলিইথিলিনের তৈরি সকল প্রকার পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ (ওভেন প্লাস্টিক ব্যাগসহ) ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর ৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আদায়ের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান সরবরাহ পর্যায়ে এই সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেনি। নিরীক্ষা সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ২ কোটি ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ৯১২ টাকা সম্পূরক শুল্ক ও ৩২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৮৬ টাকা ভ্যাট ফাঁকি পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি মোট ২ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ২৯৯ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করেনি।
২০২২ সালের ১৫ মার্চ ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত ১ কোটি ৪৯ লাখ ৬২ হাজার ৬৩৭ টাকা ও মূসক ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৩৯৫ টাকা পরিশোধে ন্যায় নির্ণয় আদেশ করে খুলনা ভ্যাট কমিশনারেট। প্রতিষ্ঠানটি ওই সময় ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মূসক ও সম্পূরক শুল্ক পরিশোধ করে দেয়। ফলে চলতি নিরীক্ষা মেয়াদে প্রতিষ্ঠানের পরিশোধ করা ১ কোটি ৭২ লাখ ৭ হাজার ৩২ টাকা বাদ দিলে বাকি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৬৫ টাকা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে ৬৮ লাখ ১৩ হাজার ২৭৪ টাকা সম্পূরক শুল্ক ও ১০ লাখ ২১ হাজার ৯৯১ টাকা ভ্যাট রয়েছে। অন্যদিকে, স্থানীয় উপকরণ ও সেবা ক্রয়ের বিপরীতে গৃহীত রেয়াত বাবদ ১০ হাজার ৬৯১ টাকা এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় যথাসময়ে মূল্য ঘোষণা প্রদান না করায় ৭.৫-এর অতিরিক্ত মূল্যের বিপরীতে অতিরিক্ত গৃহীত রেয়াত হিসাবে ৩ লাখ ৮০
হাজার ৯৯৮ টাকার ফাঁকির তথ্য বেরিয়ে আসে। এছাড়া সিএ ফার্মের অডিট রিপোর্ট মোতাবেক বিভিন্ন খরচের বিপরীতে উৎসে মূসক বাবদ ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৯৬৫ টাকার ঘাপলা পাওয়া গেছে।
সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি রেয়াত ও উৎসে মূসক বা ভ্যাট বাবদ মোট ১ কোটি ২ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫৪ টাকা শুল্ক-ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ধারা-১২৭ অনুযায়ী ভ্যাট প্রদেয় হওয়ার নির্ধারিত তারিখের পরবর্তী দিন হতে প্রকৃত পরিশোধের দিন পর্যন্ত বকেয়ার ওপর মাসিক সুদও প্রযোজ্য হবে; যা আদায়যোগ্য বলে মনে করছে ভ্যাট অফিস। নথিপত্র যাচাই-বাছাই ও প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য অনুসারে কর ফাঁকির অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়। খুলনা ভ্যাট অফিসের ডেপুটি কমিশনার বিল্লাল হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিম অডিট ২০২৪ সালের ৬ এপ্রিল তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে আকস্মিক অডিট অভিযানও পরিচালনা করেছিল বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, খুলনা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অফিস থেকে ওই ফাঁকিকৃত ভ্যাটের ওই টাকা পরিশোধে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পরিহারকৃত মূসক ও উৎসে মূসক বাবদ ওই টাকা জরিমানাসহ কেন আদায় করা হবে না, সে বিষয়ে বক্তব্য থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। সে হিসাবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়ে। শুনানিতে প্রতিষ্ঠানটির এমডি বা তাদের মনোনীত প্রতিনিধিকে লিখিত জবাব ও প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ (পাঠযোগ্য) উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। আর শুনানি প্রদানে ব্যর্থ হলে ‘বক্তব্য নেই’ বলে ধরে নেয়া হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেসার্স অলিম্পিক ফাইবার লিমিটেডের ভ্যাট ম্যানেজার গোলাম মোস্তফার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে দুদিন ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দিলে তিনি সিন করেন। কিন্তু কোনো জবাব দেননি।
এ বিষয়ে খুলনা ভ্যাট কমিশনারেটের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এর আগেও প্রতিষ্ঠানটির সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। এবার নিরীক্ষার মাধ্যমে সম্পূরক শুল্কের পাশাপাশি কয়েকটি খাতে ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমরা ডিমান্ড নোটিশ করেছি। তারা জবাব দিলে দেবে। তারা প্রমাণাদি উপস্থাপন করতে না পারলে ফাঁকি দেয়া ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দিতে হবে। না হয় আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেব।