আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা: জীবনের অধিকার হচ্ছে মানবীয় মর্যাদাসহ বেঁচে থাকার অধিকার। স্বাস্থ্যের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অসংক্রামক রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অসংক্রামক রোগ। অসচেতনতার কারণে অসংক্রামক রোগের সঙ্গে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। দেশে প্রতিটি পরিবারে একজন বা একাধিক ব্যক্তি অসংক্রামক রোগাক্রান্ত রয়েছে। সংক্রামক রোগের সঙ্গে অসংক্রামক রোগের বৃদ্ধি অনেকটা উত্তপ্ত আগুনের চুল্লিতে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো অবস্থা বলা যায়। এছাড়াও জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা বিশ্বে সবচেয়ে কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে মানুষ স্বাভাবিক কর্মক্ষমতার চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন। শুধু তা-ই নয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে স্বাস্থ্য সমস্যাও বাড়ছে, এই গবেষণা তথ্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস-২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে খাদ্য সংকট, অনিরাপদ খাদ্য, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, অপুষ্টি, সুপেয় পানির সংকট, বায়ু ও শব্দদূষণ, সিসাদূষণ, স্থুলতা, মুটিয়ে যাওয়া, ব্রেন স্ট্রোক, হƒদরোগ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া, থ্যালাসেমিয়া, নিউমোনিয়ায়, যক্ষ্মা, জলাতঙ্ক ইত্যাদি জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেÑসড়কে অপমৃত্যু, পঙ্গুত্ব, পানিতে ডুবে মৃত্যু; যা জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা ও উন্নয়নে জন্য ‘শাঁখের করাত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালে অসংক্রামক রোগে ৮ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। আইসিডিডিআর,বি’র তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে মোট মৃত্যুর ৫৯ শতাংশ হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে এবং এ কারণে বছরে আট লাখ ৮৬ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অপরদিকে বাংলাদেশে ২০ শতাংশ পুরুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগলেও ৩২ শতাংশ নারী ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপে। তামাক সেবন ও উচ্চ রক্তচাপের কারণে বাংলাদেশে উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে কম বয়সী হƒদরোগী। হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। সুষম খাদ্য গ্রহণে অসচেতনতা, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ও তৈল জাতীয় খাবার গ্রহণ, বায়ু ও শব্দদূষণ হƒদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত। পাশাপাশি নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যের জোগান নিশ্চিতের অভাবে এবং অজ্ঞতা, জ্ঞান স্বল্পতার কারণে অথবা বাধ্য হয়ে মানুষ প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবারের দিকে ঝুঁকছে। ফলে ৪টি অসংক্রামক রোগের (হƒদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, ডায়াবেটিস) ঝুঁকি বাড়ছে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের অভাবে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপজনিত হƒদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি এবং মৃত্যু দ্রুতহারে বাড়ছে। বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বের অসংক্রামক ও প্রতিরোধযোগ্য অসুস্থতা এবং মৃত্যু ৩০ শতাংশের জন্যই দায়ী অস্বাস্থ্যকর খাদ্য ও পর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রমের অভাব। ‘অ্যাসেসমেন্ট অব সল্ট কন্টেন্ট অ্যান্ড লেবেল কমপ্লায়েন্স অব কমনলি কনজিউমড প্রোসেসড প্যাকেজড ফুডস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক হার্ট ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাজারের প্রক্রিয়াকৃত মোড়কজাত খাবারের ৬১ শতাংশেই নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি লবণ। ফলে প্যাকেটজাত খাবার থেকে এখনই অতিরিক্ত লবণ কমিয়ে আনতে না পারলে মানুষের মধ্যে স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ ও হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বাড়বে। আর উচ্চ রক্তচাপ বাড়লে নষ্ট হতে পারে চোখ, কিডনিসহ শরীরের নানা অঙ্গ। একই সঙ্গে হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকিও বাড়বে খাবারে লবণ কমাতে না পারলে। খাদ্যাভ্যাস কমাতে পারে উচ্চ রক্তচাপজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি।
বাংলাদেশের ফুসফুসের প্রধান রোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑসিওপিডি, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, যক্ষ্মা, আইএলডি, ফুসফুস ক্যানসার। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংতই সিওপিডি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত এবং বাংলাদেশে ২০ মিলিয়ন মানুষ ধূমপানে আক্রান্ত। ক্যানসার রোগের অন্যতম কারণ ধূমপান। এটি ফুসফুস ক্যানসারের প্রধান কারণ। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুতের প্রধান চারটি কারণের একটি তামাক। অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত অসুখে বছরে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ (৩ কোটি ৭৮ লাখ) তামাক ব্যবহার করছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট প্লানেটারি হেলথ জার্নালে ‘পল্যুশন অ্যান্ড হেলথ: আ প্রোগ্রেস আপডেট’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন প্রকার দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮২৪ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে শুধু বায়ুদূষণের কারণেই সর্বাধিক ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫১৫ জনের মৃত্যু হয়। অতিমাত্রায় বায়ুদূষণের কারণে দিন দিন বাড়ছে অ্যাজমার ব্যাপকতা। শিশুসহ যেকোনো বয়সী নারী-পুরুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। দেশের প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষ অ্যাজমা রোগে ভুগছেন। দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর কারণ পানি দূষণ। প্রতি বছর পানি দূষণে ৩০ হাজার ৮৭৪ জনের প্রাণহানি হয়। এছাড়া অন্যান্য দূষণজনিত মৃত্যুর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিসা দূষণ। সিসা দূষণের কারণে দেশে ৩০ হাজার ৭৭৭ জনের মৃত্যু হয়। সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। সিসার কারণে শিশুদের সারাজীবনের জন্য স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিকতার মুখে পড়তে হয়। বাংলাদেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশুর রক্তে (৬০ শতাংশ) উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে এক কোটি শিশুর রক্তে রয়েছে ১০ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটারের অধিক সিসা রয়েছে। বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে এ সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশি। এর প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে এবং লেখাপড়ায় তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবলÑসরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) সম্প্র্রতি গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্বের সর্বোচ্চ যক্ষ্মা আক্রান্ত ২২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশে প্রতি বছর তিন লাখ নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। আর প্রতি বছর যক্ষ্মায় মারা যাচ্ছেন ২৯ হাজার মানুষ এই তথ্য প্রকাশ করেছে আইসিডিডিআর,বি। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন রোগটিতে ১০৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পরিসংখ্যান বলছে, এ সংখ্যা আরও বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’-তথ্য মতে, দেশে নিউমোনিয়ার কারণে ৫ বছরের কম বয়সী ৪৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর হচ্ছে। ২০০০ সালে ১৫ লাখের বেশি শিশু মারা গেছে নিউমোনিয়ায়। ২০১৯ সালে কমবেশি ৬ লাখ ৭০ হাজার শিশু মারা গেছে নিউমোনিয়ায়।
বর্তমানে স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো স্ট্রোক। স্ট্রোকজনিত মৃত্যু জাতীয় সমস্যা। দেশে স্ট্রোক রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। আর সরকারি হাসপাতালে যত রোগী মৃত্যুবরণ করেন তার ২০ শতাংশই স্ট্রোক রোগী। পরিবারের কর্মক্ষম তথা উপার্জনের ব্যক্তিটি পঙ্গুত্ববরণ করলে পুরো পরিবারের ওপর নেমে আসে দুঃষহ যন্ত্রণা ও কষ্ট। উপার্জন বন্ধ হওয়ায় সংসারে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। তখন স্ট্রোক আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের, পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে স্থূলতা ও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ওজন বিশিষ্ট হওয়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। শারীরিক ওজন উচ্চতার তুলনায় বেড়ে যাওয়া ও মুটিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি। গ্রাম অথবা শহর উভয় অঞ্চলেই অপর্যাপ্ত কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম না করার কারণে স্থুলতা ও মুটিয়া যাওয়া মানুষের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। গ্রামীণ নারীরা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তাদের বেশি পরিশ্রম করতে হয় শহুরে নারীদের তুলনায়। এক গবেষণা বলছে, শারীরিক পরিশ্রমের কাজ যারা করেন তাদের চেয়ে কর্মহীন নারীরা বেশি স্থূল। অপর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রমের কারণে প্রতি বছর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে এক লাখ ২৯ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৯১ হাজারের অধিক মানুষই মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। আমাদের দেশে প্রতি ১ লাখে ২৬০ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণ না করলে ২০৫০ সালে প্রতি ১ লাখে ১ হাজার ১৫০ জন মারা যেতে পারে। বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ ক্যানসার রোগী প্রায় ৫ বছরের মধ্যে মারা যায়। দেশে ক্যানসার রোগীর মৃত্যুর হার বর্তমানে প্রায় ৮ শতাংশে এবং এই সংখ্যা ২০৩০ সালে এটি ১৩ শতাংশ উন্নীত হবে। বাংলাদেশে নারীরা যেসব ক্যানসারে আক্রান্ত হন তার মধ্যে স্তন ক্যানসার শীর্ষে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ হাজারের বেশি মানুষ স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ থ্যালাসিমিয়া রোগের বাহক। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ অজ্ঞাতসারে থ্যালাসিমিয়া রোগের বাহক। প্রতিবছর ৭ হাজার শিশু থ্যালাসিমিয়া নিয়ে জš§ নেয়। বর্তমানে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬০ হাজার। থ্যালাসিমিয়া বাহকদের পরস্পরের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর নতুন করে ৭ হাজার থ্যালাসিমিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্ম নিচ্ছে। দেশে জলাতঙ্ক রোগে বছরে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে ৯৫ শতাংশ জলাতঙ্ক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে। ঢাকায় বছরে ৬৬ হাজার মানুষকে কুকুরে কামড়ায়। জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ রোগ লক্ষণ একবার প্রকাশ পেলে রোগীকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে অনুকূল পরিবেশ পেয়েই বাড়ছে এডিস মশা। ফলে ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুর বাহক এ মশার বিস্তার সারাদেশে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬২ হাজার ১২৭ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হয়েছেন এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৭৮ জনের। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, মারা যান ১৫৪ জন। মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবই মশা বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ৫৪টি জেলার নলকূপের পানি-পরীক্ষার মাধ্যমে আর্সেনিক আক্রান্ত সর্বমোট রোগী ৩৮,৩২০ জন (২০০৮-০৯ জরিপ সূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদনে তথ্য প্রকাশিত হয়। আর্সেনিক থেকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ব্যক্তিবিশেষ এবং তার পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১০ সালে ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
ডায়রিয়ার ঘটক হচ্ছে দূষিত পানি ও খাবার। কভিডের সংক্রামণ কমে আসা এবং স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজনের ঘনঘন হাত ধোয়া এবং জীবাণুনাশক দিয়ে হাত পরিষ্কার করার প্রবণতা কমে আসছে। ডায়রিয়ার জীবাণু ছড়ানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম হচ্ছে পানি। ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটি হচ্ছে খাবার প্রস্তুত, স্পর্শ করা, পরিবেশন করা ও খাবার খাওয়ার আগে, শৌচাগার ব্যবহারের পর, বাইরে থেকে ফিরে এসে হাত ধুয়ে নেয়া। কারণ হাত দিয়েই মানুষ সবকিছু স্পর্শ করে এবং সবচেয়ে বেশি জীবাণু বহন করে। ৩০ বছর আগেও বার্ষিক পাঁচ লক্ষাধিক শিশু মৃত্যুর ৩৩ শতাংশের দায় ছিল ডায়রিয়ার।
যদিও রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন এবং জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা এবং জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার প্রতি জোর দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, ২০১১-এর মূল লক্ষ্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদসমূহ অনুসারে পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন করা। কারণ উক্ত স্বাস্থ্যনীতিতে মানব উন্নয়নের সূচক হিসেবে স্বাস্থ্য সার্বজনীনভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ৩ নম্বর লক্ষ্যে: সব বয়সী মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সব মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বাত্মক আহ্বান জানানো হয়েছে। তাই রোগ হওয়ার পর নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থার দিকে জোর দেয়া প্রয়োজন। প্রতিরোধ ব্যবস্থা সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে ঝুঁকি ও ব্যয় কমাবে, যা রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে।
আইনজীবী