মফিজ জোয়ার্দ্দার, চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গা জেলায় অসময়ে তরমুজ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষক। বিঘাপ্রতি ৪০ থেকে ৪৮ হাজার টাকা খরচ করে খরচ বাদে তারা আয় করছেন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। এ জন্য তারা সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন। তাই তরমুজের বাম্পার ফলনে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন তারা।

কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে চার হাজার ২৭৪ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় তিন হাজার ৭৮ বিঘা, দামুড়হুদা উপজেলায় ৫৭৩ বিঘা, জীবননগর উপজেলায় ২১৮ বিঘা ও আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৩৮ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে।
কৃষি অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, অল্প খরচে ৪৫ দিন থেকে শুরু করে ৬৫ দিনের মধ্যে এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হওয়ায় এ জেলায় তরমুজ চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দীননাথপুর গ্রামের তরমুজচাষি হারিচ মিয়া জানান, তরমুজ বেলে-দোআঁশ মাটিতে ভালো হয়। এটা গ্রীষ্মকালীন ফসল। সাধারণত চৈত্র মাসের প্রথম দিকে রোপণ করা হয়। বৈশাখ শেষে ফসল ওঠে। কিন্তু চলতি মৌসুমে রমজানের কারণে ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়ে রোপণ করা হয়েছে।
ফাল্গুন মাসে রোপণ করলে ভাইরাস লাগার আশঙ্কা থাকে। গত বছর দুই ধাপে তিনি আড়াই বিঘা জমিতে সাগর কিংস জাতের তরমুজ চাষ করেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে দেড় বিঘা, পরে এক বিঘা। এ জাতের তরমুজ চার-পাঁচ কেজি সাইজের হয়।
গত বছর তিনি সর্বোচ্চ দুই হাজার ৮০০ টাকা মণ দরে তরমুজ বিক্রি করেছিলেন। তিনি আড়াই বিঘা জমিতে এক লাখ টাকা খরচ করেন। খরচ বাদে তার প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। চলতি মৌসুমে তিনি দুই বিঘা ব্ল্যাক বেরি জাতের তরমুজ চাষ করেছেন। এই জাতের সাইজ তিন থেকে চার কেজি হয়।

তিনি জানান, ‘এ বছর ৩০ হাজার টাকার মতো তরমুজ বিক্রি করেছি। এ বছর যা জমিতে দণ্ডায়মান আছে, করোনার কারণে সেগুলোর বাজার কেমন হবে জানি না। তবে তরমুজ চাষ খারাপ নয়। এ চাষে কোনো লোকসান নেই। দাম যাই হোক খরচ উঠে যায়।’
একই উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের আব্দুল কাদের জানান, ‘ধান, ভুট্টা, গম, পাট, শসা, বেগুন, পটোলসহ বিভিন্ন চাষ আমার আছে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে পরীক্ষামূলকভাবে থাইল্যান্ডের ব্ল্যাক বেরি দিয়ে তরমুজ চাষ শুরু করি। অন্য ফসলে যত বেশি শ্রম দিতে হয়, এখানে তেমন শ্রম প্রয়োজন হয় না। উপজেলায় আমাদের মতো অন্যান্য এলাকার কৃষক তরমুজ লাভজনক হওয়ায় এই চাষে ঝুঁকে পড়ছেন।

এটা খুবই লাভজনক সবজি।’ তিনি জানান, ‘বিঘাপ্রতি ব্ল্যাক বেরিতে যা খরচ হয়, গোল্ডেন ক্রাউনে একই খরচ হয়। বিঘাপ্রতি ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়।’ তিনি জানান, ‘গত বছর বাজার ভালো ছিল। বিঘাপ্রতি আড়াই লাখ টাকার তরমুজ বেচাকেনা করেছি। খরচ বাদে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছে। এবার করোনার কারণে ৫০ হাজার টাকা বাদ দিয়ে এক লাখ টাকা লাভ হবে।’
তিনি বলেন, ‘ব্ল্যাক বেরির চেয়ে গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজের দাম ও চাহিদা বেশি হওয়ায় চলতি বছর চার বিঘা জমিতে গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজ চাষ করেছি। এ বছর বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে মার্কেটে ক্রেতা কম থাকায় কেমন লাভ হবে, বলতে পারছি না। তবে লোকসান হবে না, লাভই হবে।’
একই গ্রামের জামালের কলেজপড়–য়া ছেলে সামিম জানায়, ‘এ বছর আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারলাম না। পরীক্ষা হবে কি না জানি না। আগামী বছর আবার পরীক্ষা দেব।’ সে জানায়, ‘এক বিঘা জমিতে গোল্ডন ক্রাউন জাতের তরমুজ চাষ করেছিলাম। ক্ষেত ভালো হয়েছে।’ সে আরও জানায়, ‘তরমুজ উঠতে শুরু করেছে। সে লক্ষ্যেই লেবার নিয়ে ক্যারেট ভর্তি করছি। ট্রাকও প্রস্তুত। চট্টগ্রামে পাঠাব। করোনার কারণে বাজারের অবস্থা কেমন হবে, জানি না।’
লেবার মিলন জানান, ‘দিনমজুরি করে সংসার চালাই। করোনার কারণে এ বছর তরমুজ বাইরে যাওয়া বন্ধ ছিল। এখন বাইরে যাওয়া শুরু হয়েছে। সারা দিন তরমুজের ট্রাক সাজিয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পেয়ে থাকি। তা দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলে।’
চুয়াডাঙ্গা সদর কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ তালহা জুবায়ের মাসরুর নিউটন বলেন, ‘তরমুজ চাষ মাচাই পদ্ধতিতে হয়। পাঁচ-ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে খুবই আলোচিত তরমুজের ক্ষেত। চুয়াডাঙ্গা জেলায় গত বছরের তুলনায় প্রায় ডাবল জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। চলতি মৌসুমে চার হাজার ২৭৪ বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছে। করোনার কারণে প্রথম দিকে একটি আশঙ্কা ছিল-বাজার কেমন হবে? সেটা কেটে গেছে। এখন বাজার উঠতির দিকে এসেছে। এটা একটা লাভজনক ক্ষেত।’
তিনি জানান, ‘কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকের উৎপাদিত ফসল বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা প্রত্যয়নের ব্যবস্থা করছি, যাতে পথে দুর্ভোগের শিকার না হয় কৃষক। তরমুজ চাষে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে কৃষক দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করতে পারে।’
তিনি আরও জানান, তরমুজ বিঘাপ্রতি গড়ে ৮০ মণ করে উৎপাদিত হয়। তাহলে এ জেলায় চার হাজার ২৭৪ বিঘায় এক মৌসুমে তিন লাখ ৪২ হাজার মণ তরমুজ উৎপন্ন হবে। প্রতি মণ তরমুজ দুই হাজার থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায় বেচাকেনা হয়। সে দাম না ধরে যদি মণপ্রতি কৃষক গড়ে এক হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করেন, তাহলে এক মৌসুমে চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪১ কোটি ৪০ লাখ টাকায় তরমুজ বিক্রি হবে। তাই বলা যায়, তরমুজ চুয়াডাঙ্গা জেলায় অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।