Print Date & Time : 14 September 2025 Sunday 7:06 am

অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক সুবর্ণজয়ন্তীর শপথ

কাজী সালমা সুলতানা: বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী চলছে আর বিজয়ের ৫০ বছর। এক বড় অহংবোধের দিন, বড় আনন্দের দিন। এই বিজয় বাঙালি জাতিকে দিয়েছে স্বাধীনসত্তা, স্বাধীন ভূ-খণ্ড। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি পেল একটি জাতি রাষ্ট্র, ‘বাংলাদেশ’। এই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে ঝরেছে অনেক প্রাণ। এর পেছনে রয়েছে অনেক সংগ্রামী মানুষের ত্যাগ। অনেক প্রেরণাদায়ী সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মাঝে হঠাৎ করেই ভুল জাতিসত্তার পরিচয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের অংশ হয় এই বাংলা। শুরু হয় সংগ্রামের নতুন পথ। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে এক ভুলের ফসল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি। ভাষার প্রশ্নে প্রথম রক্ত ঝরে রাজপথে। এরপর ধারাবাহিক সংগ্রামের পথে আসে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ বাঙালি স্বাধীনতার ডাক পায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জনসমুদ্রে ঘোষণা দেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’

অপারেশন সার্চলাইট নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধংসযজ্ঞে লিপ্ত হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণার পূর্ণতা অর্জন হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, মহান বিজয়ের মাধ্যমে। ইতিহাসের জঘন্য ও বর্বরতম গণহত্যা, হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিজয়ের দিন। ৯৩ হাজার প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দিন। দীর্ঘদিনের স্বাধীনতা সংগ্রাম আর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর।

বাঙালি জাতির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। কিন্তু যুগ যুগ ধরে এ জাতি বিদেশি শাসন-শোষণ আর নিপীড়নের শিকার হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভেঙে দুটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলমানদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় এক হাজার ৩০০ মাইল দূরত্বে থাকা আজকের বাংলাদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামে জিন্নাহর স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয়। বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের জাতিসত্তার পরিচয় পরিবর্তিত হয়ে যায় ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে। যদিও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমান ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ আরও ক্ষুদ্র জাতির জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। প্রকৃতপক্ষে দ্বিজাতিতত্ত্বের একটি অসার ও ভ্রান্ত তত্ত্ব ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের নিগড়ে বন্দি করা। এর প্রমাণ মেলে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাত মাসের মাথায়। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে শাসকগোষ্ঠী জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে গিয়ে রচিত হয় ভাষা আন্দোলন ও অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। এ ভাষা আন্দোলনই বীজ বপন করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার।

ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন জনগোষ্ঠী পাকিস্তানিদের অপতৎপরতা সম্পর্কে সজাগ হতে থাকে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও তখন পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অবশেষে ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ), কৃষক প্রজা পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম একত্র হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। এ নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সংসদের ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন লাভ করে। যুক্তফ্রন্টের শরিক দল আওয়ামী লীগ একাই পায় ১৪৩টি আসন। নির্বাচনের পর দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করেন।

সব রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দিয়ে আইয়ুব খান দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৬২ সালে এসে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ঘোষণা করেন জেনারেল আইয়ুব খান। এ রিপোর্ট নিয়ে ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। বন্দুকের নল দিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করেন আইয়ুব খান। প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন স্থগিত করা হয়। কিন্তু এ আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে একটি নতুন ধারার জš§ দেয়। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের একটি অংশ অনুধাবন করে স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে জাতিকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। ছাত্রলীগের এমন চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে তিন নেতা মিলে গঠন করেন গোপন একটি সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’। এই তিন ছাত্রনেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান (পরবর্তীকালে জাসদের তাত্ত্বিক গুরু), আবদুর রাজ্জাক (প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা) ও কাজী আরেফ আহমেদ (পরবর্তীকালে জাসদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা; কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত)। তারা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের প্রগতিশীলদের স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ এবং বিপ্লবী পরিষদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত তারা সারাদেশে প্রায় ৭০ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেন। ছাত্রলীগের এই গোপন সংগঠনের নেতারা বৃহত্তর পরিসরে ছাত্রলীগকে কাজে লাগিয়ে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যান এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপ দিতে নিরলসভাবে কাজ করেন। পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদও এ পরিষদের নেতৃত্ব দেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ছয় দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই ছয় দফার বিরোধিতাও করেন। কিন্তু ছাত্রলীগ এই ছয় দফাকে সমর্থন দিয়ে বিবৃতি, মিছিল ও মিটিং শুরু করে। ক্রমেই ছয় দফা জনপ্রিয় দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। আন্দোলনের তীব্রতা বুঝতে পেরে জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরও ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। ষড়যন্ত্রমূলক এ মামলার বিরুদ্ধে বাঙালি তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। অবশেষে আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পান।

আইয়ুব খানের পতনের পর পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন দেন। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এ নির্বাচন বাঙালির দীর্ঘদিনের নিপীড়ন, নির্যাতন ও বঞ্চনার অবসান ঘটানোর সুযোগ করে দেয় এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পথ উš§ুক্ত হয়। কিন্তু এক হাজার ৩০০ মাইল দূরের পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান নামক উদ্ভট রাষ্ট্রের অংশ করা হয়েছিল মূলত শোষণের জন্য। সেই শোষণের পথ বন্ধ হওয়া কোনোভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই তারা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে বাঙালি জাতিকে হত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা বাঙালি হত্যার নীলনকশা হিসেবে তৈরি করে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা শুরু করে, হত্যাযজ্ঞ চালায় ঘুমন্ত বাঙালিদের। তারা পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক, খিলগাঁওয়ে আনসার সদর দপ্তর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সশস্ত্র হামলা চালায়। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের। এরপরই রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, যুবক, পালিয়ে আসা সামরিক বাহিনীর সদস্যসহ ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। এসব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আকাশ ও নৌপথেও হামলা চালায়। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করে। লাখো নারী, যুবতী ও কিশোরীকে ধর্ষণ করে। লুণ্ঠন করে মানুষের মূল্যবান সম্পদ। ভীতসন্ত্রস্ত ও অসহায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির এক দলিল থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রধান শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং এক মাসের মধ্যে সব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী কিংবা সামরিক ব্যক্তিদের নির্মূল করার পরিকল্পনা ছিল অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম বিষয়।

পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ মোকাবিলা করতে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধ। ভারতে আশ্রয় নেয়া ছাত্র-যুবকরা সাধারণ প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে প্রবেশ করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবিলা করতে যুদ্ধ শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার শপথ গ্রহণ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করা শুরু হয়।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ছয় দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। এ ঐক্যবদ্ধতার প্রতিফলন ঘটে মহান মুক্তিযুদ্ধে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করতে নানা অনুষ্ঠান চলতে থাকে। ফুটবলাররা গড়ে তোলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগসহ কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ছাড়া সমাজের সব শ্রেণির নাগরিক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। দেশের সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

২৬ মার্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে নগর-শহর-গ্রামগঞ্জ ভস্মীভূত করে, তার খুব অল্পই বিশ্ববাসী জানতে পারে। এ সময়ে সাংবাদিকদের চলাফেরা, সংবাদ সংগ্রহ ও সংবাদ পাঠানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। জুলাই থেকে সাংবাদিকরা গোপনে সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। তখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে শুরু করেন। কিছু দেশ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত গণহত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত ক্রমান্বয়ে জোরদার হতে থাকে। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানা এবং পাকিস্তানবিরোধীদের সম্পর্কে সহজে জানতে ও প্রাথমিক প্রতিরোধ কাজে সহযোগিতার জন্য দখলদার বাহিনী গড়ে তোলে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যরা প্রধানত রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীতে যোগ দেয়। এসব বাহিনী পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করে। হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনা মোতাবেক রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায় এবং সেনাক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করে; বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত করে এবং গুলি করে হত্যা করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধকালে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা ছাড়াও প্রায় পাঁচ লাখ মহিলাকে নির্যাতন ও ধর্ষণ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অগণিত বাঙালি নারীকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক নীলিমা ইব্রাহিম তার রচিত ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ গ্রন্থে নির্যাতিত মহিলাদের সরাসরি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধকালে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের বীরাঙ্গনা নামে সম্মানিত করেন। বাংলাদেশের মতো এত বড় গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এ যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা বসনিয়া কিংবা রুয়ান্ডার গণহত্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্বের কোনো যুদ্ধে এত সাধারণ মানুষ হত্যার শিকার হয়নি।

ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ জোরদার হতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এদিকে ৩ ডিসেম্বর ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশে সৈন্য পাঠায়। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাস্ত হতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী একের পর এক পর্যুদস্ত হয়ে ঢাকায় আটক হয়ে যায়। ঢাকার চারদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। অবশেষে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার পরিসমাপ্তি ঘটে। বিশ্বের ইতিহাসে দুটি মাত্র যুদ্ধে লিখিতভাবে আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটে। সেই ইতিহাসে বাংলাদেশ স্থান করে নেয়। এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী সোভিয়েত বাহিনীর কাছে লিখিতভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল।

বিজয়ের এই সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি আমরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদ আর প্রায় পাঁচ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এ যুদ্ধে বাংলার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানÑঅর্থাৎ ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষ সবাই যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। সেই সব শহিদদের রক্তের মর্যাদা ও সম্মান জানিয়ে আমরা কি একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? সেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হোক মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর শপথ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com