Print Date & Time : 7 July 2025 Monday 2:25 am

অস্টিওআর্থ্রাইটিস চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি

বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির বিস্তৃতি: ফিজিওথেরাপি হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত একটি চিকিৎসা সেবা পদ্ধতি, যা ওষুধ ছাড়াই মানুষকে সচল, সক্ষম, কর্মক্ষম, পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল এবং পুনর্বাসনে সহায়তা দেয়।

বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপির জš§ কথা: ঢাকা মেডিকেল কলেজে ১৯৬১ সালে ফিজিওথেরাপির যাত্রা শুরু হয় অধ্যাপক আবুল হোসেনের নেতৃত্বে। কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় দীর্ঘ দিন ফিজিওথেরাপিতে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলে তার হাতে ফিজিওথেরাপি বিভাগের গোড়াপত্তন হয়। শুরুতে ফিজিওথেরাপির বিকাশ ছিল ধীর গতিতে, পরবর্তী সময় স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব হয়ে পড়ে অপরিসীম।

ব্রিটিশ ফিজিওথেরাপিস্ট ভ্যালরি টেলর ১৯৬৯ সালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে ভেলরি টেইলর আহত মুক্তি যোদ্ধাদের ফিজিওথেরাপি দেয়া শুরু করেন এবং ১৯৭৯ সালে সাভারে সিআরপি (পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র) স্থাপন করেন। সিআরপি ব্রিটিশ ও অন্য দেশি দাতাগোষ্ঠী থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সাভারে ও মিরপুরে ফিজিওথেরাপি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। সূত্র: পরিসংখ্যান ব্যুরো।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থপেডিক সার্জন রোনাল্ড জি জার্স্ট ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসে সরকারকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সব সাধারণ রোগীর জন্য একটি অর্থপেডিক হাসপাতাল করার প্রস্তাব দেন। তার প্রচেষ্টায় তৎকালীন সরকারের সহযোগিতায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা শুরু হয়। শেরেবাংলা নগরে ২০০২ সালের অক্টোবরে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় জাতীয় অর্থপেডিক্স ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। ডা. রোনাল্ড জি জার্স্ট নিটোর হাসপাতালে কাজ শুরু করেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে এবং বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ক্রমাগত অবহিত করেন। জাতীয় অর্থপেডিক্স ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার চেষ্টায় ফিজিওথেরাপি নতুন জীবন লাভ করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের পরামর্শ ও নির্দেশক্রমে মুক্তিযুদ্ধের ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ স্বাধীনতা- উত্তরকালে গণস্বাস্থ্য পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে জনহিতকর ট্রাস্ট হিসেবে নিবন্ধিত হয়। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ট্রাস্টের উন্নয়নের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু প্রায় ৩১ একর জমি ভূমি দখল করিয়ে দেন। ১৯৯৪ সালে গণস্বাস্থ্য জনহিতকর ট্রাস্ট গণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। অর্থনীতিবিদ আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ৩১ জন বুদ্ধিজীবী, প্রশাসক, সমাজসেবক ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের পরামর্শক্রমে প্রণীত রূপরেখায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিশেষ বিভাগ হিসেবে ফিজিওথেরাপি বিভাগের ১৯ নভেম্বর ১৯৯৫ থেকে  কার্যক্রম শুরু হয়।

ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব বাড়ছে কেন? প্রথমত, বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্য গড় আয়ু বৃদ্ধির ফলে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে; ৬০-ঊর্ধ্ব বছরের বয়োবৃদ্ধদের সংখ্যা জনশুমারি ২০১১তে ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ তা বেড়ে বর্তমান ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ হয়েছে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ । অতীতে কেবল অবস্থাপন্ন পরিবারে বয়োবৃদ্ধ লোকের সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। বর্তমানে গ্রামের প্রায় পরিবারে একজন হলেও একজন বৃদ্ধ পুরুষ বা মহিলার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বড় কোনো রোগ না থাকা সত্ত্বেও অনেকে অচল হয়ে বাড়িতে বসে থাকেন। বয়স্ক মানুষের শরীরের নানা ধরনের ব্যথা, স্ট্রোক, মবিলিটি সমস্যা এবং অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধিসহ প্রভৃতি কারণে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে। তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ পরিস্যখ্যান ব্যুরো। দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত ও পুষ্টিহীনতার কারণেও প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। তৃতীয়ত: যানবাহন বৃদ্ধি হওয়ায় দেশে দুর্ঘটনা বাড়ছে। দুর্ঘটনায় সবাই মারা যায় না। যারা বেঁচে থাকেন তারা প্রতিবন্ধী হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন।

অন্যদিকে দুর্ঘটনায় যারা বেঁচে যান তারা হাসপাতালে সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পান না। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু থাকলেও তা অপরিপূর্ণ। কারণ ফিজিওথেরাপি সম্পর্কে এমবিবিএস, ডেন্টাল ও নার্সিং ছাত্রদের কোনোরূপ জ্ঞান দেয়া হয় না। ফলে ব্যান্ডেজ বা প্লাস্টার করে দীর্ঘদিন বিশ্রামে থাকার কারণে মাংসপেশী শুকিয়ে যায় বা জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়, যা অনায়াসে ফিজিওথেরাপি  চিকিৎসা দ্বারা সচল রাখা যেত। এই তথ্য অনেক চিকিৎসকই জানেন না। রেফারেল পদ্ধতির প্রচলন না থাকায় এক চিকিৎসক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে রোগী রেফার  করেন না। চতুর্থত: উন্নয়শীল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারণে ও দুর্ঘটনা এবং স্ট্রেস বাড়ছে। পঞ্চমত, বর্তমানকালে সবচেয়ে ভয়াবহ বৈশিক মহামারি কভিড আক্রান্ত রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ফিজিওথেরাপি একটি কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা যা বিভিন্ন গবেষণায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।

ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এখনও প্রত্যেক জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ন্যূনতম দুইজন করে স্নাতক ফিজিওথেরাপিস্টের পদ সৃষ্টি করেননি এবং ন্যূনতম সুবিধা ও সাধারণ যন্ত্রপাতি দিয়ে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু হয়নি।

বাংলাদেশে বর্তমানে ফিজিওথেরাপি বিষয়ে চার বছর কোর্স ও এক বছর ইন্টার্নশিপ মেয়াদি গ্র্যাজুয়েশন কোর্স পাসকৃত আনুমানিক তিন হাজার প্রফেশনাল আছে, যা বর্তমানে ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ ফলাফল অনুযায়ী ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন জনগোষ্ঠীর চিকিৎসার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাথাপিছু/ জনপ্রতি ফিজিওথেরাপিস্ট গড়ে ৬০ হাজার। তাই বাংলাদেশের সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে এক লাখ ফিজিওথেরাপিস্ট দরকার। প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে ন্যূনতম দুজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট ও পাঁচজন ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্টের  প্রয়োজন হবে। (তথ্যসূত্র: প্রাগুক্ত) 

ফিজিওথেরাপিস্টদের কর্মসংস্থান সম্ভাবনা:  বাংলাদেশ ও দেশের বাইরে প্রায় ৩০ হাজার ফিজিওথেরাপিস্টের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, নার্সিং ও বিডিএস মেডিকেল কলেজের ইউনিট হিসেবে পরিচালিত হলে ফিজিওথেরাপি কোর্সকে মেডিকেল কলেজের ইউনিট হিসেবে পরিচালনায় বাধার সংগত কোনো কারণ নেই। এমবিবিএস, বিডিএস এবং  ফিজিওথেরাপি কোর্সে উল্লেখযোগ্য সামঞ্জস্য রয়েছে: এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্টি, প্যাথলজি এবং মাইক্রবায়োলজি, কমিউনিটি মেডিসিন প্রভৃতি মেডিকেলের মূল বিষয়ের সঙ্গে ফিজিওথেরাপিতে আরও কিছু বিষয় যেমন কাইনেসিওলজি, ইলেকট্রথেরাপি, থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ, বায়োমেকানিক্স, অর্থপেডিক মেডিসিন, ফিজিওথেরাপি ইন কার্ডিওপালমোনারি, ফিজিওথেরাপি ইন নিউরোলজি অ্যান্ড পেডিয়াট্রিকস, জেরিয়াট্রিকস (বয়োবৃদ্ধদের সমস্যা), রিহ্যাবিলিটেশন মেডিসিন, র্স্পোটস ফিজিওথেরাপি, প্রস্থেটিকস অ্যান্ড অর্থটিকস প্রভৃতি অধ্যয়ন করতে হয়।

এই তিন কোর্সের ছাত্রদের একই ল্যাবরেটরিতে কাজ শিখতে হয়, পাশাপাশি রোগীর সেবা দিতে হয়। তাছাড়া মেডিকেল কলেজের একাধিক সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি,প্যাথলজি যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ল্যাবরেটরিগুলো ফিজিওথেরাপি ছাত্রদের ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

ফিজিওথেরাপি বিভাগ মেডিকেল কলেজের ইউনিট হলে ছাত্ররা এ হাসপাতালের যাবতীয় সুবিধা গ্রহণ করতে পারবে এবং ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার পাশাপাশি রেফারেল পদ্ধতির প্রচলন ও কমপ্রিহেনসিভ  চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রফেশনাল ও প্রশাসনিক সমন্বয় যেমন সহজ হবে, তেমনি একই রোগী হাসপাতালের সব ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ পাবে। এছাড়া ফিজিওথেরাপি আলাদা হলে প্রতিষ্ঠানটি একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং ছাত্ররা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে।

অন্যদিকে মেডিকেল কলেজের ইউনিট না করে আলাদা ফিজিওথেরাপি কলেজ করা হলে নিন্মলিখিত অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।

ক) শিক্ষকের স্বল্পতা: সরকারি ও বেসরকারি প্রায় সব মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকের স্বল্পতা রয়েছে। আলাদা ফিজিওথেরাপি কলেজের জন্য মেডিকেল শিক্ষক সংগ্রহ অসম্ভব হবে। বর্তমানে ভালো বিষয়ভিত্তিক ল্যাবরেটরির অভাব রয়েছে।

অদ্যাবধি বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপিতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই কম। একমাত্র মাস্টারস অব ফিজিওথেরাপি কোর্স ২০০৮ সালে মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে সর্বপ্রথম গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয়, যোগ্য শিক্ষক এবং দক্ষ প্রফেশনাল তৈরি করার লক্ষ্যে সার্বিক সহযোগিতা পেলে তবেই ভবিষ্যতে  সে

প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা সম্ভব হবে। খ) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণ ব্যয়, হাসপাতাল পরিচালনা ও অন্যান্য কারণে ফিজিওথেরাপি কোর্স পরিচালনার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে এবং এর ফলে ছাত্রদের শিক্ষা খরচও অনেক বেড়ে যাবে। বর্তমানে ৫ বছর মেয়াদি ফিজিওথেরাপি ব্যাচেলর কোর্সের  জন্য খরচ যেখানে মাত্র ৩-৪ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়, আলাদা প্রতিষ্ঠান হলে এই ব্যয় বেড়ে ১০-১৫ লাখ টাকার প্রয়োজন হবে। দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্ট প্রশিক্ষণ করাও অতীব প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বিবেচনা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশে ন্যূনতম দুই লাখ ডিপ্লোমা ফিজিওথেরাপিস্ট স্বব্যয়ে নিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।

মর্মকথা: চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপিস্টদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাই লক্ষ্য।

নাসিমা ইয়াসমিন

উপাধ্যক্ষ ও সহযোগী অধ্যাপক

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ফিজিওথেরাপি কলেজ

তারেক মো. শাহরিয়ার

প্রভাষক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ফিজিওথেরাপি কলেজ

ফিরোজ মিয়া

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক ফিজিওথেরাপি কলেজ