আসুন একটি দৃশ্য কল্পনা করি। আমরা ছোটবেলায় শুনতাম দুষ্ট লোক দমন করতে কিছু বিশিষ্ট লোক লাঠি চালিয়ে দিতে পারেন, যে লাঠিটি নিজেই চলে গিয়ে সেই দুষ্ট লোকের পিঠে চড়াও হবে। সাধারণত চোর ধরতেই নাকি এমন কাজ করা হতো। সে যাই হোক, আজ আমরা দুষ্ট ব্যাকটেরিয়া মারতে এমন লাঠির সাহায্য নেব।
মনে করুন, আপনার পাকস্থলিতে খাদ্যের সঙ্গে পাঁচটি কালো বর্ণের দুষ্ট ব্যাকটেরিয়া ঢুকে গেল। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো সেখানে পৌঁছামাত্র দুষ্টামি শুরু করে দিল, নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করতে থাকল। তখন পর্যন্ত সংখ্যায় কম বলে আপনি টের পেলেন না। কিন্তু এরা প্রতি ২০ সেকেন্ডে দ্বিগুণ হতে থাকল। এভাবে পাঁচটি থেকে ১০টি, ১০টি থেকে ২০টিÑহতে হতে যখন ৮০টি হয়ে গেল তখন এদের নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থে আপনার পেটে গোলযোগ শুরু হয়ে গেল। আপনি ছুটলেন সেই বিশিষ্ট লোকের খোঁজে যিনি লাঠি চালিয়ে দুষ্ট দমন করেন।
সেই ভদ্রলোক সেলামির বিনিময়ে দিলেন লাঠি চালিয়ে আপনার পেটে, মুখে বললেন, ‘যারে লাঠি যা, যারে দেখবি কালা তারে মাইরা ফ্যালা।’ তবে একবার চালিয়ে দেওয়া লাঠি আট ঘণ্টা পর্যন্ত সক্ষম থাকে বলে আট ঘণ্টা পর নতুন লাঠি পাঠাতে হবে। এভাবে তিন দিন উত্তমমধ্যম খেলে দুষ্ট ব্যাকটেরিয়ার বংশ নির্বংশ হয়ে যাবে। এখন লাঠি ছুটল পাকস্থলির উদ্দেশে। সেখানে কালো বর্ণের শুধু দুষ্ট ব্যাকটেরিয়াই নেই, ২০টি ভালো ব্যাকটেরিয়াও আছে। কিন্তু লাঠি গণহারে এই ১০০টি কালো মারতে থাকে, সে হোক দুষ্ট কিংবা নিতান্ত নিরীহ বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া। লাঠি শুধু গায়ের রংটিই চিনতে পারে, ব্যাকটেরিয়াটি উপকারী না অপকারী তা বোঝার ক্ষমতা লাঠির নেই। ১০০টি ব্যাকটেরিয়া তো লাঠির আঘাতে ত্রাহি ত্রাহি শুরু করল। অকস্মাৎ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ৫০টি রোগা-পটকা ব্যাকটেরিয়া প্রথম আট ঘণ্টায় মারা গেল, যারা একটু হƒষ্টপুষ্ট তারা শুধু টিকে থাকল। আপনি একটু ভালো বোধ করলেন। কারণ একে তো ৫০টি মারা গেছে, তার ওপর বাকি ৫০টিরও নিজের জান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে বলে দুষ্টামি কিছু কমেছে।
এবার চালিয়ে দিলেন আর একটি লাঠি। নতুন লাঠির আগমনে কালো ব্যাকটেরিয়ার বুঝতে বাকি থাকল না যে এ যাত্রায় বাঁচতে হলে সবটুকু ?দিয়ে লড়তে হবে। তারা নিজেদের কোষ ও বাইরে প্রয়োজনীয় জিন খুঁজতে লাগল। কিন্তু ততক্ষণে আরও ২৫টি কালো ব্যাকটেরিয়া মারা গেল। আপনি আরও একটু ভালো বোধ করলেন। বাকি ২৫টি বসল জরুরি বৈঠকে, সিদ্ধান্ত হলো জান লাগিয়ে লড়ার। এ সময় ওদের মধ্যে একটু বেঁটে মতন চকচকে মাথার একটি কালো ব্যাকটেরিয়া বলল, ‘দেখুন জনাব, আমি এর আগেও আমার আগের বাসস্থানে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ওই সময় কোথা থেকে যেন শুধু লৌহ-গোলক পড়ছিল আর মাথা বরাবর আঘাত করছিল। কেউ কেউ মাথাকে লুকিয়ে রেখে সাময়িক বাঁচতে পারছিল, তবে পাকাপোক্তভাবে নয়। আমি খেয়াল করলাম পাশের বাসার রইসরা দিব্বি ভালো আছে। কারণ ওদের সবার মাথা ছিল আয়রন দিয়ে বাঁধানো। এই এখন আমার মাথাটি যেমন ঠিক তেমন। আমি রইসের কদাকার বোনটিকে পটিয়ে বিয়ে করতে চাইলাম, যাতে আমার মাথাও তার মতো হয়। কিন্তু সে কুৎসিত শয়তান আগেই এক বিচ্ছুকে মন দিয়ে রেখেছিল। তাই যখন একেবারেই ভেঙে পড়েছি আর মাথাতে উপর্যুপরি আঘাত পেতে পেতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি, তখন হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক করে রইসের দাদা আমার জন্য সুসংবাদ এনে দিয়েছিল। আমি মৃত বুড়োটির কোষ থেকে ধাতব মাথা তৈরির জিন সবার অলক্ষ্যে নিজের কোষে ঢুকিয়ে নিলাম। আর মাথাটাকে এমন ধাতব করে ফেললাম।
আপনারা দেখেন আমাদের চারপাশে সাদা ব্যাকটেরিয়াগুলো কেমন দাঁত কেলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদেরকে এই লাঠিগুলো মারছে না। আসুন ওদের সঙ্গে মেলামেশা করি, নয়তো সাদা মৃত ব্যাকটেরিয়া থেকে সাদা চামড়ার জন্য দায়ী জিন সংগ্রহ করি। সবাই এই অতি চতুর ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে কাজে নেমে গেল। কিন্তু ততক্ষণে চলে এসেছে তৃতীয় লাঠি। মারা গেল আরও ১৩টি কালো ব্যাকটেরিয়া। বাকি থাকল ১২টি। এদের মধ্যে পাঁচটি সাদা হওয়ার জ্বিন সংগ্রহ করতে সমর্থ হলো। তবে এরা পুরোপুরি সাদা না হয়ে ছাই বর্ণের হলো। কারণ এদের কোষে কালো বর্ণের জন্য দায়ী জিনও আছে। চতুর্থ লাঠিটি এদেরকে আবছা দেখতে পেল বলে এরা ঘায়েল হলেও এ যাত্রায় বেঁচে গেল। তবে পঞ্চম লাঠিটি এলে এদের আর শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হলো না। কিন্তু এই পাঁচটি দুষ্ট ব্যাকটেরিয়া সংখ্যায় এত কম যে আপনি একদম সুস্থ বোধ করলেন আর সিদ্ধান্ত নিলেন যে আর লাঠি চালান দেবেন না। বরং বাকি লাঠিগুলো রেখে দেবেন পরবর্তী সময়ের জন্য। এতে আপনার কিছু টাকা বাঁচবে। বেঁচে যাওয়া পাঁচটি ব্যাকটেরিয়া তো উৎসব শুরু করে দিল কারণ এখন তারা অনেক শক্তিশালী। লাঠি চালিয়ে এখন আর তাদের কাবু করা যাবে না। আর পাঁচটির মধ্যে ওই বেঁটে মতন ধাতব মাথার চিকন বুদ্ধির ব্যাকটেরিয়াটিও আছে। সে তো নিজেকে সুপার বাগ বলে ঘোষণা করে দিল, কেননা লাঠি বা ধাতব বল কেউ-ই আর তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তার পরবর্তী প্রজš§ও সুপার বাগ হয়ে যাবে। সে সবাইকে আহ্বান জানাল, নতুন বাসস্থান খুঁজে বের করে সুখে-শান্তিতে জীবন যাপন করার জন্য।
উপরিউক্তভাবেই আসলে রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া ও সুপারবাগ তৈরি হয়। লাঠি বা গোলক হলো দুই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ। অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহারই রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে আর কোর্স শেষ না করে এদের বাইরে ছড়িয়ে যেতে আমরা সাহায্য করি। বেশি ব্যবহার ও অকাজে ব্যবহার ব্যাকটেরিয়ার রেজিসট্যান্ট হওয়ার সম্ভাবনাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকবার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর যারা ওই ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্ট নয়, তারা মারা যায় আর যারা রেজিস্ট্যান্ট তারা বেঁচে থাকে ও বংশ বৃদ্ধি করে। এজন্য বারবার ব্যবহারের ফলে ড্রাগ রেজিসট্যান্ট ব্যকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। একটি জরিপ বলছে, আমেরিকায় গবাদি পশুপাখির ব্যবহƒত অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ৭০ ভাগই ব্যবহার করা হয় সুস্থ পশুপাখির জন্য। জানি না আমাদের দেশে এমন জরিপ চালালে তা কতটা ভয়াবহ ফল দিত। পশুপাখিতে অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহার প্রতিনিয়ত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি করছে, আর তা মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে। শুধু পশুপাখি নয়, মানুষও অপ্রয়োজনে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগ ব্যবহার করে। যেসব ছোটখাটো সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক না খেলেও চলে সেক্ষেত্রেও মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে চিকিৎসককে প্ররোচিত করে। এছাড়া প্রায়ই ভাইরাল সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাগের ব্যবহার হয়, যখন কি না ভাইরাসের জন্য এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলো মোটেই কার্যকর নয়। ভাইরাসের গঠন ও বংশবৃদ্ধির ধরনটাই ভিন্ন বলে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’ তত্ত্ব এখানে কাজ করে না। ভাইরাসের জন্য ব্যবহার করা ড্রাগকে অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ বলে। এইচআইভি ভাইরাস ছাড়া বেশিরভাগ ভাইরাসকে শরীর নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তবে ভাইরাল সংক্রমণের সময় যখন যুগপৎ ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের ঘটনা ঘটে বা আশঙ্কা থাকে তখন চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিতে পারেন।
এত দিন যেভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহƒত হয়ে আসছে তাতে পরিবর্তন আনাটা এখন সময়ের দাবি। পরিস্থিতিকে শুধরে না নিলে আমাদের আবার অ্যান্টিবায়োটিক আসার আগের সময়ে ফিরে যেতে হবে, যখন সামান্য দাঁত পড়া থেকেও কারও মৃত্যু হতে পারে। নতুন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হলেও আচরণ পরিবর্তন না করলে এসব নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি ব্যাকটেরিয়াগুলো রেজিস্ট্যান্ট হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। আর আচরণ পরিবর্তনের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে টিকা কর্মসূচি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ যৌনমিলন ও জীবাণুমুক্ত খাবার খাওয়ার প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রতিরোধ
ভাইরাল সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নয়।
চিকিৎসক যেভাবে যত দিন খেতে বলবেন, ঠিক সেভাবে তত দিন খেতে হবে। ভালো বোধ করলেই খাওয়া বাদ
দেয়া যাবে না।
অন্য কারও বেঁচে যাওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা
যাবে না, কারণ ভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার জন্য ভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন।
জুঁই ইয়াসমিন, পুষ্টিবিজ্ঞান প্রশিক্ষক