আইএমএফ এবং বাংলাদেশ

মনিরুল ইসলাম সৈকত: কভিড মহামারি-পরবর্তী সময় সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়। এতে  চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক দেশগুলো অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পতিত হয়। দরিদ্র আফ্রিকা থেকে উন্নত ইউরোপ পর্যন্ত প্রায় সবদিকেই এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। টিকা আবিষ্কারের ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে পড়ে সবকিছু। ধীরে ধীরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বব্যাপী  অর্থনৈতিক স্থবিরতা  দেখা যায়। 

বাংলাদেশও এর আঁচ লাগে স্বাভাবিকভাবে। সারা বিশ্বে দেখা যায়, ডলার সংকট। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেহেতু ডলারের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল, তাই ডলারের সংকটের ফলে দেশের অর্থনীতিতে একজনের টালমাটাল অবস্থা শুরু হয়। দ্রুত নেমে যায় টাকার মান। সর্বশেষ  তথ্য পাওয়া পর্যন্ত প্রতি ডলার ১০৬.৬৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের ফলে সারা বিশ্বে এক ধরনের চাহিদার কমতি দেখা যায়। এতে করে কমে যায় রপ্তানি। এছাড়া রপ্তানির উচ্চ জাহাজ ভাড়ার কারণে এটি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। উচ্চ জাহাজ ভাড়া এবং উচ্চমূল্যে পণ্য আমদানি করার ফলে অত্যন্ত দ্রুত রিজার্ভ থেকে ডলার ব্যয় হতে থাকে। চাপ বাড়তে থাকে রিজার্ভের ওপর। আদর্শ অর্থনৈতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো ডলার থাকতে হয়। ৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভকে নিরাপদ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব করে দেখায় পাওনা পরিশোধের পরে ২৮ বিলিয়ন ডলার মজুত আছে। এতে দেশে একধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়।

ঠিক এ সময়ে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ঋণের আবেদন করেন। তিনি উল্লেখ করেন ভবিষ্যৎ সংকট থেকে রক্ষা পেতেই এ ঋণ নেয় বাংলাদেশ সরকার।

বাংলাদেশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের পর্ষদ বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য প্রায় ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ প্যাকেজের অনুমোদন করে। এ ঋণের পাশাপাশি নানারকম শর্তাবলি আরোপ করেছে আইএমএফ। শর্ত বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আগামী ৪২ মাসে ৭ কিস্তিতে এ অর্থ পাবে বাংলাদেশ। প্রতি কিস্তির আগে প্রদত্ত শর্তাবলি পূরণে ব্যর্থ হলে সেটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

গত ২ ফেব্রুয়ারিতে প্যাকেজের ঋণ প্যাকেজের প্রথম কিস্তি তে প্রায় ৪৭ কোটি  ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে সামান্য কিছু বেড়েছে রিজার্ভ।

অর্থের পরিমাণ বিবেচনা করলে ৪৭০ কোটি ডলার বাংলাদেশের মতো ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দেশের জন্য খুব বেশি কিছু না। সাধারণ মানুষের উদ্বেগের কারণ আইএমএফের সংস্কারমূলক কড়া শর্তাবলি। সাধারণ মানুষ ভাবছে বাংলাদেশ এসব শর্তাবলি পালনে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়াতে পরিণত হবে।

আইএমএফ যে শর্তগুলো দিয়েছে সেগুলো মূলত অর্থনৈতিক সংস্কারকেন্দ্রিক। বাংলাদেশকে আইএমএফ যে ঋণ সাহায্য  দিয়েছে তা মূলত দুটি খাতে। প্রথমটি বাজেট সহায়তা (ঊীঃবহফবফ ভঁহফ ভধপরষরঃু)তে প্রায় ৩.৩ বিলিয়ন এবং জলবায়ুজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় ১.বিলিয়ন ডলার পাবে বাংলাদেশ। এটি খুবই পরিষ্কার যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই এ ঋণ সাহায্যের মূল উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হলো আইএমএফ সাহায্যের সঙ্গে যে শর্তের বেড়াজাল দিয়েছে সেটি কি বাংলাদেশ বইতে পারবে?ন াকি সংকট কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তে পুনরায় সংকটে পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতি। কারণ অর্থনীতি তে এখন ভয়াবহভাবে চোখ রাঙাচ্ছে মূল্যস্ফীতি।

ঋণ প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে আইএমএফের বেশ দুর্নাম রয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার পর হিতে বিপরীত অবস্থা দেখা দিয়েছে অনেক দেশে। অনেক ক্ষেত্রে আই এমএফ এ ঋণ পরিশোধ করার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো পুনরায় ঋণ নেয়। এতে এক ধরনের ঋণের ফাঁদে পড়ে দেশগুলো।

কেনিয়া ও মিশরের মতো দেশগুলো আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে বেকায়দায়  পড়েছিল। সে দেশের জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামে এবং সরকারকে এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থায় ফেলে। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে তারা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটে পড়ে।

সাধারণ একটি দেশে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা গেলে তখন সে দেশটি আইএমএফ থেকে ঋণ  নেয়। তবে প্রায় সব ঋণ  প্যাকেজের ক্ষেত্রে আইএমএফ নানা শর্ত জুড়ে দেয়। সেই ধারায় বাংলাদেশকেও বিভিন্ন শর্ত দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ই এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে আইএমএফের লোন পেয়েছে।

এবার বাংলাদেশের শর্তাবলি প্রসঙ্গে আসা যাক।

বাংলাদেশ কি আইএমএফ থেকে লোন নিয়ে আদৌ উপকৃত হবে? নাকি এটি হয়ে দাঁড়াবে গলার কাঁটা?

গলার কাঁটা  বা বিপদ হয়ে উঠবে কি না তা নির্ভর করে সরকার  শর্তগুলো কত দক্ষতার সঙ্গে পালন করতে পারে তার ওপর। বাংলাদেশ নিজেদের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে শর্ত পূরণ করতে পারলে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোতেও অগ্রগতি সাধন হবে; তবে মুদ্রার উল্টাপেটের কথাও চিন্তা করতে হবে। যথেচ্ছ ব্যবহার না হলে দিন শেষে আইএমএফের ঋণ পরিণত হবে মরণ ফাঁদে।

আইনের যেসব শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো আর্থিক খাতের সংস্কার, মুদ্রা বিনিময় হারের সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সংস্কারসহ আরও ৩০টির অধির ছোট-বড় শর্ত রয়েছে।

শর্তগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শ কাতর এবং উদ্বেগজনক হলো জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমানো, বিভিন্নভাবে করের আওতা বাড়ানো। জ্বালানি তেল অর্থনীতির প্রধান উপাদান। জ্বালানি তেলের সঙ্গে পুরো অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্পর্কযুক্ত। জ্বালানি তেল থেকে ভর্তুকি কমালে এর দাম বাড়ে। আর এতেই প্রভাব পড়ে পুরো অর্থনীতির ওপর। গত বছর বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বাড়তি দেখিয়ে এর দাম ৩০-৪০% বাড়ায় সরকার। একদিকে কভিড-পরবর্তী সময়ে মানুষের আয় কমে গিয়েছে, ক্রমাগত বাড়ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। মধ্যবিত্তরা হয়েছে দরিদ্র আর দরিদ্ররা হয়েছে অতিদরিদ্র। ওএমএসের ট্রাকের পেছনে সারি দীর্ঘ হচ্ছে। অপরদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বাজারে প্রতিটি জিনিসের দাম রেকর্ড ছুয়েছে। এতে দুর্ভোগ এ পড়ছে সাধারণ মানুষ। ভর্তুকি কমাতে গিয়ে জ্বালানি তেলের দাম যদি আরেক দফা বাড়ায় সরকার তাহলে এর পরিণাম হতে পারে মরণঘাতী। নির্বাচনের বছরে এমন সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে অজনপ্রিয় করে তুলতে পারে সরকারকে। এছাড়া ডলারের দাম বাড়ায় ঋণপত্র (খবঃঃবৎ ড়ভ পৎবফরঃ) খুলতে বেগ পেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এতে অর্থনীতি আরও সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বিশ্ববাজারে যদি জ্বালানির দাম দাম পুনরায় বাড়ে তাহলে বাধ্য হয়েই সরকারকে পুনরায় সমন্বয় করতে হবে। এতে দাম আরও বাড়বে।

এত গেল জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের নেতিবাচক প্রভাব। এছাড়া করের আওতা বাড়ানো, রাষ্ট্র মালিকাধীন ব্যাংকের ঋণখেলাপি কমানো (১০ শতাংশের নিচে আনা), রিজার্ভ গণনার হিসাব নির্ধারণ করা, জিডিপির সঙ্গে রাজস্ব আয়ের অনুপাত ঠিক রাখা, সামাজির সুরক্ষার আওতা বাড়ানো, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্র আলাদা করা, বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া, কার্বন ট্যাক্স প্রণয়নসহ নানা কঠিন শর্ত দিয়েছে আইএমএফ।

এসব সংস্কারের কথা আগে থেকেই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। টেকসই অর্থনীতি (ঝউ)ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ইত্যাদি সংস্কারমূলক শর্তগুলো সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের আর্থিক এবং ব্যাংকিং খাতে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। একটি গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যাংক খাতকে ব্যবহার করছে। এ কারণে আইএমএফ বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জলবায়ুজনিত ঝুঁকি নির্ধারণ বিষয়ক, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উপস্থাপন উপস্থাপন, ঋণখেলাপির তথ্য সংযোজনসহ বেশকিছু শর্ত দিয়েছে তারা। এসব শর্ত বাস্তবায়ন হলে আর্থিক খাতের অরাজকতা কিছুটা হলেও বন্ধ হবে।

আইএমএফের আরেকটি সংস্কারের জায়গা হলো কর রাজস্ব খাত। বাংলাদেশ আয়কর আদায়ের হার অন্য দেশের তুলনায় কম। এ কারণে প্রতি বছর রাজস্ব ঘাটতি দেখা যায়। এ কারণে আইএমএফ করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের লোন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এর আগেও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে লোন নিয়েছিল। প্রতিবারই কোনো না কোনো সংস্কারের কথা বলা হলেও সেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। অনেক অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনৈতিক এ সংকটের মধ্যে শর্তগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে বর্তমান সংকটের সময়ে কিছুটা হলেও ইতিবাচক হতে পারে এ ঋণ প্যাকেজ। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে শর্তগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি লক্ষ্য হিসেবে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

তবে এটাও মনে রাখতে হবে, শর্তগুলো মানতে সাধারণ মানুষের এর দুর্ভোগ এর কারণ না হয়। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এর দাম যেন লাগামহীন না হয় সে বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে সরকারের। প্রয়োজন হলে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। তাহলে প্রকৃত সুফল আনয়ন সম্ভব।

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়