Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 5:41 pm

আইটি কর্মকর্তাদের ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তন: হুমকিতে ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা

 

আহমেদ সাঈফ মুনতাসীর: ব্যাংকিং খাতের আইটি কর্মকর্তারা বারবার চাকরি পরিবর্তন করছেন। ফলে এক ব্যাংকের তথ্য চলে যাচ্ছে অন্য ব্যাংকে। এতে ব্যাংকগুলোকে পড়তে হচ্ছে বাড়তি ঝুঁকিতে।সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় বলা হয়, ব্যাংকের আইটি কর্মকর্তাদের ৩০ শতাংশ অন্তত এক থেকে তিনবার করে চাকরি পরিবর্তন করেছেন। ২৩ শতাংশ চার থেকে ছয়বার ও ১৪ শতাংশ কর্মকর্তা সাতবারের বেশি চাকরি পরিবর্তন করেছেন। তবে আইটি কর্মকর্তাদের অবশিষ্ট ৩৩ শতাংশ তাদের ক্যারিয়ারের কোনো অবস্থাতেই চাকরি পরিবর্তন করেননি।

গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে আমাদের দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অধিকতর দক্ষ ও মেধাবী কর্মী নিয়োগের প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোয় অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবল নিয়োগের প্রচেষ্টা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কর্মকর্তাদের মধ্যে ঘন ঘন চাকরি পরিবর্তনের প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তাছাড়া দিনে দিনে ব্যাংকগুলো পুরোপুরিভাবে অনলাইননির্ভর হয়ে যাওয়ার ফলে ব্যাংকে আইটি অফিসার নিয়োগের প্রয়োজন পড়ছে। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল আইটি কর্মীদের সংখ্যা। সরকারি ব্যাংকগুলোয় এ অবস্থা আরও শোচনীয়। সেখানে প্রতি ১৯০ জন সাধারণ কর্মকর্তার বিপরীতে মাত্র একজন আইটি কর্মকর্তা কাজ করেন। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় এ পার্থক্য আরও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় প্রতি ৫০১ সাধারণ কর্মকর্তার বিপরীতে একজন আইটি কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় আইটি ও নন-আইটি কর্মকর্তাদের পার্থক্য কম। বেসরকারি প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে গড়ে প্রতি ৭৯ নন-আইটি কর্মকর্তার বিপরীতে একজন করে আইটি কর্মকর্তা রয়েছেন। আর বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় প্রতি ৩৩ নন-আইটি কর্মকর্তার বিপরীতে একজন আইটি কর্মকর্তা রয়েছেন।

ব্যাংকগুলোয় বেশিরভাগ আইটি কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্ট নন। মোট আইটি কর্মকর্তার ৬৪ শতাংশ মনে করে তারা কর্মক্ষেত্রে ভালো নেই। মাত্র ৮ শতাংশ মনে করে তারা খুব ভালো আছেন, মোটামুটি ভালো আছেন এমন মত ব্যক্ত করেছে ২৮ শতাংশ। কর্মক্ষেত্রে আইটি কর্মকর্তাদের অসুখী হওয়ার কারণ হিসেবে দীর্ঘক্ষণ অফিসে থাকা, নির্দিষ্ট টাইমজোন না থাকা, শুক্র-শনিবার অফিস থাকা, ঈদ-পূজাসহ ধর্মীয় উৎসবগুলোয় ছুটি না থাকা, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও সেই অনুসারে বেতন না হওয়াকে দায়ী করেন। ব্যাংকের আইটি ও নন-আইটি কর্মকর্তাদের বেতনের স্কেল আলাদা হওয়াতেও হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেকে। আইটি কর্মকর্তাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ তাদের প্রাপ্ত বেতন নিয়ে অখুশি, ৮২ শতাংশ বোনাস নিয়ে ও ৫০ শতাংশ প্রমোশন পলিসি নিয়ে অখুশি। এসব কারণে ব্যাংকের আইটি কর্মকর্তাদের মধ্যে চাকরি পরিবর্তনের প্রবণতা বেশি।

সরকারি ব্যাংকের তুলনায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় আইটি কর্মকর্তাদের চাকরি পরিবর্তনের হার বেশি। এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় আইটি কর্মীদের বেতন সাধারণ নন-আইটি কর্মকর্তাদের তুলনায় বেশ কম। তাছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় চাকরির নিরাপত্তা কম। তাই ভালো সুযোগ পেলে কেউ প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা না করে নতুন সুযোগকে গ্রহণ করে অনায়াসে।

আইটি কর্মকর্তাদের এই দ্রুত চাকরি পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকগুলো সাইবার ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একজন ব্যাংক আইটি কর্মকর্তা ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অনেক বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকেন। ফলে পুরো সাইবার সিস্টেম সম্পর্কে তাদের একটি সম্যক ধারণা থাকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর। এক্ষেত্রে সৎ ও দক্ষ কর্মীদের দক্ষতা ও কাজের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট। তবে অধিক হারে চাকরি পরিবর্তনের প্রবণতা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি করে। যদি এই পরিবর্তন হয় আইটি কর্মীদের ক্ষেত্রে, তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয় সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারটি।

যদিও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আইটি কর্মীদের পরিবর্তন ব্যাংকের জন্য হুমকি নয়। কেননা যেসব আইটি কর্মকর্তা ব্যাংকের কোর নেটওয়ার্ক ও ডেটাবেজে কাজ করেন, তাদের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ডেটাবেজ থেকে সব পাসওয়ার্ড ও হিস্ট্রি ডিলিট করে নতুন পাসওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তাই সাইবার নিরাপত্তাহানি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে বারবার পুরো সিস্টেম ও ডেটাবেজের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন ঝামেলাপূর্ণ। এক্ষেত্রে অল্প একটু অসাবধানতা বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে বলেও মনে করেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা পরিচালনাকারী বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় পরিচালনার বিষয়টি অভিজ্ঞ আইটি কর্মীদের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কর্মীদের চাকরি পরিবর্তনের উচ্চহার কখনই কাম্য নয়। একটি ব্যাংকে বারবার আইটি কর্মী পরিবর্তন হওয়া ব্যাংকগুলোর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। কোনো ব্যাংকের আইটি টিমের চার-পাঁচজন যখন একসঙ্গে চাকরি পরিবর্তন করেন, তখন সেটি সে ব্যাংকের জন্য একটি বড় ধরনের বিপর্যয় নামিয়ে আনে। এছাড়া চাকরি পরিবর্তনের উচ্চহার প্রতিষ্ঠানের কাক্সিক্ষত সাফল্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই আইটি কর্মীদের ধরে রাখতে হলে তাদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত আইটি কর্মকর্তা নেই। যেমন জার্মানিতে একটি ব্যাংকে যেখানে ছয় হাজার আইটি কর্মকর্তা কাজ করেন, সেখানে বাংলাদেশে ৫৭টি ব্যাংক মিলিয়ে আইটি কর্মকর্তার সংখ্যা সাড়ে চার হাজারেরও কম। এমনিতেই আইটি কর্মীদের সংখ্যা ব্যাংকগুলোয় উল্লেখযোগ্যভাবে কম, তার ওপর যদি প্রতিনিয়ত চাকরি পরিবর্তন করেÑ তাহলে ব্যাংকগুলো আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তাই ব্যাংকের নিরাপত্তার স্বার্থে আইটি কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর নজর দেওয়া উচিত।’