হামিদুর রহমান: আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করে তরুণদের প্রশিক্ষণের নামে দক্ষতা উন্নয়নের বুলি দিলেও বাস্তবে তার কানাকড়িও হয়নি। বরং নানামুখী প্রকল্পের নামে অর্থলুটই ছিল প্রধান আকর্ষণ। দেশব্যাপী আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ১ হাজার ১১৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪৩৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে আয়-ব্যয়সহ নানা অনিয়মের তদন্ত করছে। বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত অপচয়ের মহোৎসব পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, সাতটি জেলায় ‘আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য প্রায় ১ হাজার ১১৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও এতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪৩৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। জেলাগুলো হলোÑ গোপালগঞ্জ (কাশিয়ানি), ফেনী (পরশুরাম), নীলফামারী সদর, শেরপুর সদর, সুনামগঞ্জ সদর, পটুয়াখালী সদর ও ঠাকুরগাঁও সদর। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গোপালগঞ্জ (কাশিয়ানি), ফেনী (পরশুরাম), নীলফামারী সদর, শেরপুর সদর, সুনামগঞ্জ সদরে আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছে এবং পটুয়াখালী ও ঠাকুরগাঁওয়ে ভূমি প্রাপ্তির সাপেক্ষে চার তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট চারতলা ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এতে দেশের সাশ্রয় হবে প্রায় ৪৩৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
যে উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল সেই অর্থে দেশের মানুষ প্রত্যাশিত ফল পায়নি। বাইরের দেশগুলো কীভাবে কাজ করছে এবং আমাদের সক্ষমতার মধ্যে কীভাবে আমরা কাজ এগিয়ে নিতে পারি, সেসব বিষয় নিয়ে আরও স্টাডি করার প্রয়োজন। পাশাপাশি খুব বড় প্রত্যাশা না রেখে প্র্যাকটিক্যাল কাজগুলো করা দরকার। আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি উদ্যোগে ফ্রিল্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং এ ট্রেনিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি খাতে জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য এসব প্রকল্পের যথেষ্ট ব্যবহারই হয়নি। বরং আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারের নামে লুটপাটই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। আর প্রতিটি প্রকল্পেই নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জোনাইদ আহমেদ পলক।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বেশ কিছু প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ মেলেছে। অনেক প্রকল্প পেয়েছি যেগুলো অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত বরাদ্দ করা হয়েছে তা চিহিƒত করছি। আমরা আশা করছি, দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা আমরা সাশ্রয় করতে পারব।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, তদন্তে প্রকল্পগুলোর সঙ্গে বেশ কিছু অঙ্গ ও কার্যক্রম প্রকল্পের উদ্দশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এবং অপ্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চলমান প্রকল্পের এমন অঙ্গ ও কার্যক্রম বাদ দেয়া প্রয়োজন মর্মে সুপারিশ করা হয়েছে। এসব অপ্রয়োজনীয় অংশ প্রকল্পের হতে বাদ দিলে সরকারের ৬ হাজার ৯৮১ কোটি ১৫ লাখ টাকা সাশ্রয় হতে পারে। এমন অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে; যা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থের অপচয় করা হয়েছে। বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন আইটি ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন ও অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ করায় জমি কেনা বাবদ অর্থের অপচয়, অধিক ভূমি উন্নয়ন ব্যয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশস্ত, অতিরিক্ত উচ্চ ও অতিরিক্ত অবকাঠামো যেমন- আইটি ট্রেনিং সেন্টারে গুদাম নির্মাণ করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থের অপচয় করা হয়েছে। সব অধিদপ্তর ও সংস্থা হতে একই প্রকার কাজ যথা- ট্রেনিং সেন্টার, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এসবে প্রতীয়মান হয় বিসিসি, অধিদপ্তর ও হাইটেক পার্কের কর্ম বিভাজন নেই এবং সবাই একই ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সূত্র জানায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে সাড়ে ১৫ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। তবু ডিজিটাল সেবা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্নীতি কমানো, মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন, আইসিটি সেবা রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আইসিটি বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিভাগটি ৫৩টি প্রকল্প ও ৩৪টি কর্মসূচি নিয়েছে। যার মধ্যে ২২টি প্রকল্প এখনও চলমান। বাকিগুলো বাস্তবায়ন শেষ। সব মিলিয়ে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ডিজিটালাইজেশন-সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের নেয়া প্রকল্পের ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইসিটি খাতে অনেক প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর তেমন কোনো সুফল নেই। সম্ভাবনার নামে ‘গালগল্প’ শুনিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। আর প্রতিটি প্রকল্প থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জোনাইদ আহমেদ পলক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রযুক্তি খাতে অনেক দেশ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম অর্থ ব্যয় করেও আমাদের চেয়ে অনেক উন্নয়ন করেছে। বিগত সরকার নানা সময়ে উন্নয়নের নামে নানা সেøাগান দিলেও প্রকৃত অর্থে প্রযুক্তি খাতে আশানুরূপ উন্নয়ন করেনি। জাতিসংঘের ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইজিডিআই) ২০২৪এ ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। এ সূচকে ভারত (৯৭), শ্রীলঙ্কা (৯৮) ও মালদ্বীপ (৯৪) বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। ইন্টারনেটের গতি, ডিজিটাল জীবনমান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার ও ফ্রিল্যান্সিংয়েও সমপর্যায়ের অর্থনীতির দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ।