মো. আবু তারেক: ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পঙ্ক্তি দুটি দ্বারা সভ্যতা ও উন্নয়নের মূলে নারী ও পুরুষের অবদান সহজে অনুধাবন করা যায়। বর্তমান বিশ্বে পুরুষের সমান তালে অবদান রেখে চলেছে নারীরা। আগেকার সময়ের দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে পরিবারে নারীদের বোঝা হিসেবে দেখা হতো। সময়ের পরিক্রমায় আজ তারা প্রমাণ করেছে পুরুষের তুলনায় তারা কোনো অংশে কম নয়। বর্তমান নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়ে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। নারীর সক্ষমতা, শিক্ষার হার ও নেতৃত্বের গুণাবলি বৃদ্ধির অন্যতম নজির স্বয়ং বাংলাদেশ। আগের তুলনায় নারীরা অধিকার সচেতন হওয়ায় কোনো অন্যায় এখন মাথা পেতে নেয় না। প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নারীদের সচেতন হওয়াটা ইতিবাচক হলেও বেশকিছু নারী আইনের সুযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত সমাজকে বিশৃঙ্খল করে তুলছে।
দেশের আইন ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে অনুধাবন করা যায়, নারীর অধিকার রক্ষায় আইনগুলোয় বেশ কঠোর বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে, যেখানে তথ্যবহুল প্রমাণের অভাবে অপরাধীরা সহজে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে অনেক নিরপরাধীকেও, যেখানে উদ্দেশ্য থাকে হয়রানি, আর্থিক ও মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এছাড়া অভিযুক্ত নিরপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যা অপবাদ নিয়ে সমাজজীবন অতিবাহিত করতে হয়। বিবাহিত নারীদের প্ররোচনায় ব্যভিচার সংঘটিত হলেও অভিযুক্ত হয় শুধু সংশ্লিষ্ট পুরুষরা, যেখানে প্ররোচিত নারীকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করার সুযোগ না থাকায় সমান অপরাধ করেও রেহাই পেয়ে যায়। দোষ প্রমাণে শুধু স্বামী কর্তৃক তালাকের বিধান থাকলেও অতিরিক্ত মোহরানা ধার্য থাকায় বেশিরভাগই সেই পথে অগ্রসর হতে পারে না। ফলে লজ্জা ও অপমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয় পুরুষদের। ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখায় এটার সুযোগ নিয়ে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হচ্ছে। যেটা বাদীকে হয়রানি করার পাশাপাশি আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। এছাড়া বর্তমান সমাজে অতিরিক্ত মোহরানা ধার্য করাটাও একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সুযোগে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে মোহরানা আদায়ের প্রবণতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেহেতু তালাক যে পক্ষ থেকে হোক না কেন, মোহরানা অবশ্যই প্রদান করতে হবে। রাজধানী ঢাকায় দিনে ৩৮টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় ভাঙছে একটি সংসার। এক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ডিভোর্স দিচ্ছে নারীরা এবং ৩০ শতাংশ দিচ্ছে পুরুষরা। এছাড়া সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে মিথ্যা সাক্ষ্য। যেহেতু ফৌজদারি মামলাগুলো সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে নিরপরাধ কারও শাস্তি হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলো আদালতে আমলযোগ্য, তাই মামলা করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ যেকোনো জায়গা থেকে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রাখে, যেটা নিরপরাধ ব্যক্তির জন্য মানহানিকর বিষয়।
‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’ এবং ‘দণ্ডবিধি, ১৮৬০’-এর বেশকিছু ধারায় নারী নির্যাতনের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, যেখানে ধর্ষণের শাস্তি রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। ধারাগুলোর সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের মতো হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের দায়ে শুধু পুরুষের শাস্তির বিধান এবং নারীর সম্মতিক্রমে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হলেও ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণ মামলায় এককভাবে পুরুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে সমান অপরাধে জড়িত নারীরা আইনের ফাঁকফোকরের মাধ্যমে সহজে নিষ্কৃতি পেয়ে যাচ্ছে। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের মতে, ধর্ষণের মামলা প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই মিথ্যা হয়। পুলিশ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৬৭ হাজার ১১৭টি নারী নির্যাতনের মামলা করা হয়, যার প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ মামলাই মিথ্যা।
দণ্ডবিধির ১৮৬০-এর ১৯১ থেকে ১৯৬ ধারা পর্যন্ত মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মিথ্যা সাক্ষ্য সৃষ্টি এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭(১) ধারা অনুযায়ী ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জানা সত্ত্বেও মামলা করা হলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২০৯ ধারা অনুযায়ী কোনো দাবি মিথ্যা বলে জানা সত্ত্বেও প্রতারণামূলকভাবে কোনো ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে আদালতে অনুরূপ দাবি উত্থাপন করলে সে ব্যক্তিকে দুই বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাবে। এছাড়া ধারা ২১১ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ফৌজদারি মামলা উত্থাপন করার কোনো সংগত বা আইনানুগ যুক্তি নেই বলে জানা সত্ত্বেও ফৌজদারি কিংবা মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে, তবে সে ব্যক্তি দুই বছর কারাদণ্ডে এবং যদি অনুরূপ ফৌজদারি মামলায়, মৃত্যুদণ্ডে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে, কিংবা সাত বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের মিথ্যা অভিযোগ রুজু করা হয়, তবে সে ব্যক্তিকে সাত বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাবে।
মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্যদানের অপরাধে খুব নগণ্য শাস্তির বিধান রয়েছে। ধারাগুলো সংশোধন করে কমপক্ষে ১০ বছর এবং পাশাপাশি বড় অঙ্কের আর্থিক জরিমানার বিধান রাখা উচিত, যাতে অন্যদের জন্য এটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের জন্য স্ত্রীলোককে অভিযুক্ত করতে না পারা সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক। ধারাটি সংশোধন করে ব্যভিচারে প্ররোচিত স্ত্রীলোকদের জন্যও পুরুষের সমান শাস্তির বিধান রাখতে হবে। যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০০০-এর ৯(১) অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণেডর বিধান রাখা হয়েছে, তাই কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে মিথ্যা অভিযোগে জড়াতে না পারে সেজন্য সত্য উদ্ঘাটনের দিকে লক্ষ রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অসৎ উদ্দেশ্যে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। তাই কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে যাতে বিবাহবিচ্ছেদ হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণে মোহরানার পরিমাণ কমিয়ে আনার বিধান রাখতে হবে, যাতে এটাকে পুঁজি করে কেউ অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে না পারে। উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে মিথ্যা মামলা হ্রাস এবং আদালতে মামলার বোঝা হালকা হওয়ার পাশাপাশি নিরপরাধ ব্যক্তিরা গুরুতর অপবাদ থেকে রক্ষা পাবে।
দেশে ক্রমাগতভাবে অনেক অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলেছে। যদিও দেশীয় আইনগুলোয় বিভিন্ন মাত্রায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু অপরাধগুলো সেই তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মানুষকে ধাবিত করতে পারলে অপরাধগুলো বহুলাংশে কমে আসবে।
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়