তথ্য না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারেনি বীউনিক

আইন ভেঙেও ধরাছোঁয়ার বাইরে কোম্পানিগুলো

রাহমান আরিফ: বিমা কোম্পানির ব্যবসা এজেন্টনির্ভর। তাদের মাধ্যমেই দেশের জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে। নিয়মানুযায়ী এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (বিউনিক) শর্ত মেনে নিবন্ধন নিতে হয়। নিবন্ধন ছাড়া কোনো কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নেই। বিদ্যমান আইনেও ‘নিবন্ধন নবায়ন নেই’ এমন এজেন্টদের সঙ্গে লেনদেনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু আইনে থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিমা কোম্পানিগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এজেন্টের নিবন্ধন নবায়ন নেই। কিন্তু নিয়ম ভাঙলেও পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিউনিক। এখন বিষয়টি নজরে আসার পর এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিচ্ছে বিমার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

বিদ্যমান বিমা আইন অনুযায়ী, বিমা কোম্পানিতে এজেন্ট হিসেবে কাজ করার জন্য নির্ধারিত শর্ত পূরণ করে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিউনিক থেকে নিবন্ধন সনদ নিতে হয়ে। এই সনদ তিন বছর পর নবায়ন করতে হয়। নিবন্ধন ছাড়া কোনোভাবেই বিমা এজেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ নেই। কিন্তু বেশির ভাগ জীবন বিমা ও সাধারণ বিমা কোম্পানি আইন মানছে না। নিবন্ধন নবায়ন নেই এমন এজেন্টদের মাধ্যমে বিমা সংগ্রহ করছে কোম্পানিগুলো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত দেশের ২৮টি জীবন বিমা কোম্পানিতে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি এজেন্ট আছেন যাদের নিবন্ধন হালনাগাদ নয়। এসব এজেন্টের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ৪৫ হাজার ১৬৮টি বিমা করা হয়েছে। বাকি আট জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে সন্ধানী লাইফের মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্টের বিপরীতে পলিসি ইস্যুর প্রমাণ মেলেনি। আর দুইটি কোম্পানি নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছে। এ খাতের বাকি পাঁচটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি। অন্যদিকে ২৮টি সাধারণ বিমা কোম্পানিতে মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট সংখ্যা ২০০ জন। যাদের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার বিমা পলিসি ইস্যু করা হয়েছে। বেসরকারি বাকি ১২ কোম্পানির মধ্যে এশিয়া, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, ঢাকা ও মার্কেন্টাইল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট নেই। আর সাধারণ বিমা করপোরেশনসহ সাতটি কোম্পানি এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কোনো তথ্য দেয়নি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট নিয়ে ব্যবসা করা জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। কোম্পানিটির মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্টের সংখ্যা ৬ হাজার ৯৫৯ জন। এ পর্যন্ত এসব এজেন্টের মাধ্যমে প্রায় ২৪ হাজার ৮১৪টি পলিসি করেছে কোম্পানিটি। এজেন্ট সংখ্যায় এরপরের অবস্থানে রয়েছে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট সংখ্যায় ন্যাশনাল লাইফের থেকে কম হলেও তালিকার শীর্ষ ১০ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি পলিসি বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। যার সংখ্যা চলতি মাস পর্যন্ত ৭৭ হাজার ছাড়িয়েছে। জীবন বিমা খাতের আরেক স্বনামখ্যাত কোম্পানি প্রগতি লাইফ এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চার হাজার ৮৮০ জন মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট এখন পর্যন্ত প্রায় ৫১ হাজার ৩৬৬টি পলিসি সংগ্রহ করেছে। বিতর্কে এগিয়ে থাকা অন্য কোম্পানিগুলোর মধ্যে ডেল্টা, গার্ডিয়ান, মেঘনা, বেঙ্গল, আলফা ইসলামী, ফারইস্ট ইসলামী ও গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামও রয়েছে।

প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কোম্পানি সচিব আবুল হাসনাত মোহাম্মদ শামীম এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নবায়ন নেই এমন এজেন্টের সঙ্গে ব্যবসা করা নিয়ে আইনি জটিলতা রয়েছে। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী পর্যাপ্ত লোক না পাওয়াসহ আরও কিছু কারণে বাধ্য হয়ে ব্যবসা করতে হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও প্রবিধানে জরিমানা দিয়ে দেরিতে লাইসেন্স নবায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। আবার এখন এজেন্ট নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বেশকিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। যে কারণে চাইলে নবায়ন করা যাচ্ছে না। এখানে ফি বিষয় নয়, শর্ত বড় বিষয় বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা সম্ভব’।

বিমা খাতের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্টদের মাধ্যমে ব্যবসা করা আইনে নিষিদ্ধ। ব্যবসা করলেও তাদের এজেন্ট কমিশন দেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু জনবল সংকট, এজেন্ট নির্ভরতা, শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা আর বিমার পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকাসহ বেশকিছু কারণে কোম্পানিগুলোকে নিয়ম ভেঙে ব্যবসা করতে হচ্ছে। তাই ব্যবসার স্বার্থেই শাস্তির ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তাদের সঙ্গে কৌশলে কাজ করতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বিষয়গুলো অবগত, যে কারণে তারাও আইন প্রয়োগে কঠোর হয়নি। আলাপকালে একাধিক কোম্পানি শীর্ষ কর্মকর্তারা নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো নির্দেশনা দিলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন।

আলপকালে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিমা কোম্পানির জনবল সংকট পুরোনো ইস্যু। বিমায় চাকরির প্রতি মানুষের আগ্রহও কম। যে কারণে পর্যাপ্ত এজেন্ট পাওয়া যায় না। নিবন্ধন ও  নিবন্ধনের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু শর্তও মেনে চলতে হয়। ব্যবসায়িক পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় সেই শর্তপূরণ করা যায় না। আমরা বিদ্যমান আইন মেনে শৃঙ্খলতার সঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ তৈরি চেষ্টা করছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও সে বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। আমরা আইনি দিকগুলো মাথায় রেখে এজেন্ট নবায়ন করার বিষয়ে কাজ করব। বিউনিক কোনো নির্দেশনা দিলে সেটা পরিপালনের বিষয়ে বিমা কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধান করা হবে। কারণ আইন ভঙ্গের কারণে কোম্পানিগুলোর জরিমানা-শাস্তির মুখে পড়ার ঝুঁকিও রয়েছে।’

এদিকে এজেন্ট লাইসেন্স নবায়ন নিয়ে জটিলতায় ফি বাবদ আয় হারাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। অন্যদিকে বিমা কমিশন ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু এ বিষয়ে তদারকি না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিউনিক। ডিজিটাইজেশনের পর তথ্য প্রাপ্তি সহজ হওয়ায় এখন এ বিষয়ে সক্রিয় হচ্ছে সংস্থাটি। বিউনিকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ এজেন্ট রয়েছে এমন বিমা কোম্পানিগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। এজেন্টদের নিবন্ধন নবায়ন ও বিদ্যমান আইন মেনে চলার জন্য বিষয়ে কোম্পানিগুলোকে চিঠি দেয়া হবে। খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হবে। কারণ বিমার কমিশন ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও আইন পরিপালনের স্বার্থে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।