রাহমান আরিফ : বিমায় শৃঙ্খলা আনতে সক্রিয় বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বীউনিক)। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত বীউনিক অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশ সক্রিয়। এরই মধ্যে গ্রাহকের স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধে ১৫ কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগের নির্দেশ, বিমা কোম্পানির শীর্ষপদে শূন্যতা পূরণ ও ব্যবসার তথ্য প্রদানে বাধ্যবাধকতা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীউনিক। সর্বশেষ বিমা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। ২০১০ সালে প্রণীত বিমা আইনে সংশোধনীর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এমন কঠোর উদ্যোগের বিমার গতি ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু সংস্থাটির কঠোর অবস্থানের জেরে বেশকিছু কোম্পানি বিপাকে পড়বে। বিশেষ করে পারিবারিকভাবে একটি কোম্পানির ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ, আইন ভাঙলে পর্ষদ ভেঙে দেয়া ও জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো প্রশ্নে কোম্পানিগুলোর উদ্বেগ বাড়ছে। আইন সংশোধন ঠেকাতে ফের মরিয়া প্রভাবশালীরা। আগের ধারাবাহিকতায় বীউনিকের দায়িত্বশীলদের চাপে রাখার চেষ্টা চলছে।
বিমার স্বচ্ছতা-জবাবদিহির স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধান করতে চায় বিমা কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। বিআইএ প্রেসিডেন্ট সাঈদ আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা শৃঙ্খলা আনতে সক্রিয় হয়েছে, এটা বিমা খাতের জন্য ভালো উদ্যোগ। এখন আমরা আন্তরিকভাবে এ খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করছি। আইনটি বেশ পুরোনো, যে কারণে সংশোধনের বিষয়টি এসেছে। তাদের প্রস্তাবনা আমরা পেয়েছি। এখানে অনেকগুলো ইস্যু আছে, যেগুলো নিয়ে আলোচনার জায়গা আছে। আলোচনা না করে কোনো মন্তব্য করা কঠিন। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা শৃঙ্খলা ফেরাতেই কাজ করছে, আমরাও শৃঙ্খলা ফিরুক সেটা চাই। সবসময় একইভাবে সবকিছু চলবে, তা নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিমা খাত ও গ্রাহকের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো পদক্ষেপ নিলে আমরা সেটা সাধুবাদ জানাব। তারা এখন সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। কোনো বিষয়ে আপত্তি থাকলে আলোচনার মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করা হবে। অতীতের মতো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রভাবের কাছে মাথা নত করা বা বিশেষ কাউকে বাড়তি সুযোগ দেয়ার দিন শেষ। এখন বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই এ খাতকে এগিয়ে নিতে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিমা খাতে স্বচ্ছতা আনতে বিদ্যমান বিমা আইনে বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, কোম্পানি পরিচালনায় পারিবারিক আধিপত্য কমানো ও জাল-জালিয়াতি ঠেকাতে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতেই আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীউনিক। ১৫ বছরের পুরোনো আইনকে সময়োপযোগী ও অন্য আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করতেই ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৯৯টি জায়গায় সংশোধন চায় বীউনিক। এ বিষয়ে খাতসংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে ৮ জুলাইয়ের মতামত চেয়েছে সংস্থাটি। খাতসংশ্লিষ্টদের আলোচনার মাধ্যমে আইন সংশোধন করা হবে। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর কিছু কোম্পানির দায়িত্বশীলদের উদ্বেগ বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইন সংশোধনের পর কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা পরিবার প্রত্যক্ত বা পরোক্ষভাবে কোনো বিমা কোম্পানির ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। সেইসঙ্গে বিমা কোম্পানির পরিচালক, উদ্যোক্তা বা তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার বিষয়টি আইন করে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। একইভাবে জীবন বিমার এজেন্ট কমিশনের বিষয়টিও আমলে নিয়েছে বীউনিক। জীবন বিমার এজেন্ট কমিশন কমিয়ে আনা, সম্পদ বন্ধ রেখে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করা, তদন্তের প্রয়োজনে কোম্পানিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদন্তকারীদের তল্লাশি-জব্দের ক্ষমতা দেয়া, জরিমানা বৃদ্ধি, বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সেই কোম্পানির প্রিমিয়াম সংগ্রহে নিষেধাজ্ঞা দেয়া ও সম্পদ বিক্রি করে দায় পরিশোধ এবং আইন লঙ্ঘন করলে প্রয়োজনে কোম্পানির পরিচালনা ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে।
সূত্রগুলো বলছে, আইন সংশোধন ঠেকাতে পর্দার আড়ালে ফের সক্রিয় কিছু কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার আইন সংশোধনের পদক্ষেপকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। যদি বিষয়টি নতুন নয়, এর আগেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন পদক্ষেপ ঠেকাতে সংস্থাটির চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ দায়িত্বশীলদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। বীউনিকের প্রথম চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গণহারে মামলা করা হয়েছিল, যেগুলো পরে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একা নন, পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালনকারী মোশারফ হোসেন ও জয়নুল বারীও বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। বহুল আলোচিত একটি নতুন প্রজšে§র জীবন বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থানের কারণে অবরুদ্ধ ছিলেন চেয়ারম্যান জয়নুল বারী। মূলত নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগলেই কোম্পানিগুলো সংস্থাটির চেয়ারম্যান-সদস্যদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে। রাজনৈতিক প্রভাব আর বিরূপ পরিস্থিতি তৈরির কারণে বীউনিকের অনেক পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
যদিও এ বিষয়ে বীউনিকের দায়িত্বশীল কেউ মন্তব্য করতে চাননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের দাবি, গ্রাহক ও খাতের স্বার্থে বীউনিক কঠোর অবস্থান নিয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আইন সংশোধনের প্রশ্নে মতামত চাওয়া হয়েছে, সমালোচনা না করে মতামত আকারে জানালে সেগুলো আলোচনায় আসবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ৩৬টি জীবন বিমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি মিলিয়ে মোট ৮২টি বিমা কোম্পানি ব্যবসা করছে। যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি কোম্পানিও রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কোম্পানিগুলোর প্রতি আস্থার সংকট রয়েছে।