Print Date & Time : 10 September 2025 Wednesday 11:40 pm

আগামীর বাংলাদেশে প্রবীণরা থাকবেন সম্মানের সঙ্গে নিরাপদ ও আনন্দে

মাসুমুর রহমান: জাতিসংঘের উদ্যোগে সব মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে একটি সুন্দর বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা গৃহীত হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এসডিজির সফল বাস্তবায়নের ওপর। এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ৩ নম্বর ক্রমিকে আছে ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’। এ অভীষ্টের মোট ৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ অভীষ্টের ৯টি লক্ষ্যমাত্রা (৮ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা ব্যতীত, ৯ লক্ষ্যমাত্রায় দুটি) বাস্তবায়নে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এসডিজি বাস্তবায়নে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মূল দায়িত্ব একটি (১৬.১০), সহযোগী হিসেবে ৩০টি। এছাড়া তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য অধিদপ্তরের সহযোগী হিসেবে ৭টি দায়িত্ব রয়েছে। ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ তথ্য অধিদপ্তর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরসহ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার বছরভিত্তিক সমায়াবদ্ধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ জানুয়ারি ২০২১ সালে দেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার, মহিলা ৮ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর ৮ মাস। পুরুষের গড় আয়ু ৭১ বছর ২ মাস, মহিলাদের গড় আয়ু পুরুষদের থেকে বেশি, ৭৪ বছর ৫ মাস। জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ জন। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২১ জন। বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি হাজার শিশুর মধ্যে মৃত্যু হতো ১২১ জনের। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৪০-এ নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ২৭ বছরে শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ৬৭ শতাংশ কমেছে। মাতৃমৃত্যুর হার ১.৬৩ জন।

জনসংখ্যা আমাদের জন্য সম্পদ। এর কারণ হলো, এ মুহূর্তে এ জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ কর্মক্ষম মানুষ। এরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। আমাদের গড় আয়ু দিনদিন বাড়ছে। এটা একটা বড় অর্জন। কিন্তু শিগগিরই এ সংখ্যা পরিবর্তন হবে। নির্ভরশীল মানুষের অনুপাত এখন কমছে। কিন্তু খুব দ্রুতই তা বাড়বে। জনমিতিক সুবিধা বারবার আসে না। তাই এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষকে প্রবীণ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ধরা  হয়। দেশে এ বয়সের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার সাত শতাংশ বা তার বেশি হলে তাকে বয়োবৃদ্ধ সমাজ বলে। এ সংখ্যা ১৪ বা তার বেশি হলে তাকে প্রবীণ সমাজ বলে। বাংলাদেশ ২০২৯ সালে বয়োবৃদ্ধ সমাজ এবং ২০৪৭-এ প্রবীণ সমাজ হবে। এ পরিবর্তনে বাংলাদেশ সময় নেবে মাত্র ১৮ বছর।

জাপানের ক্ষেত্রে সময় লেগেছে ২৪ বছর। আমাদের পরিবর্তন জাপানের থেকেও দ্রুত হবে। নগরায়ণের ফলে গ্রামীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। বাড়ছে নগরের পরিধি ও মানুষ। নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিসহ চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি ও  সহজলভ্য হওয়ায় গড় আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আবার আমাদের জš§ ও মৃত্যু হার কমছে। ফলে আগামী বছরগুলোতে বয়স্কদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা দিনদিন কমবে। প্রবীণদের দেখাশোনা ও তাদের চাহিদা পূরণের সমস্যা দেখা দেবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে দেখাশোনার জন্য ১৩ জন কর্মক্ষম মানুষ ছিল। ২০৪০ সালে ৬ জন কর্মক্ষম ব্যক্তি একজন প্রবীণকে দেখাশোনা বা সেবাযতœ করবে। ২০৬০ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়াবে তিনজনে অর্থাৎ একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে সেবাযতœ করার জন্য তিনজন ব্যক্তির বেশি পাওয়া যাবে না। চিকিৎসা সেবার প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন হবে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। শুধু চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করলেই হবে না, তাদের খাদ্য, বস্ত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় চাহিদা ও ভিন্ন হবে। সেগুলো পূরণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের এবং দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে। অতিরিক্ত সময় ও অর্থের দরকার হবে। তাদের সুরক্ষা ও কল্যাণের বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে।

বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। বর্তমান শিশু ও তরুণদের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এজন্য তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন শিশুদের জন্য বর্ধিত বিনিয়োগ, বিশেষত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, স্যানিটেশন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া। টেকসই উন্নয়নের জন্য শিশু ও কিশোরদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব খুব বেশি দূরে নয়। এ বিপ্লবের প্রভাবে আগামীর কর্মক্ষেত্র হবে অটোমেশন ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তিনির্ভর। সনাতনী প্রতিষ্ঠান দিন দিন হ্রাস পাবে, তার জায়গায় প্রযুক্তিনির্ভর নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। শ্রম বাজারের চাহিদার পরিবর্তন হবে। সোশ্যাল ইমোশনাল স্কিলস ও অভিযোজন দক্ষতার চাহিদা বাড়বে। সে জন্য সফট স্কিলস প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুততা। এর প্রভাব পূর্বের শিল্পবিপ্লবের চেয়ে গতিশীল হবে। তাই বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শিশু-কিশোরদের পাঠ্যসূচি, শিক্ষা ও শিক্ষণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন করতে হবে। করোনা অতিমারির কালে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন ক্লাসে ইতোমধ্যে অভ্যস্ত হয়েছে। আগামী দিনে বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতার চাহিদা বাড়বে। যার মাথায় যত সমস্যার সমাধান তার তত চাহিদা বাড়বে।

বাংলাদেশের শ্রম বাজারে পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায় ৮৫ শতাংশ, আর মহিলাদের অংশগ্রহণ প্রায় ৩৬ শতাংশ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনবলের ৬০ শতাংশ শ্রম বাজারে কাজ করছে। এখনও ৪০ শতাংশকে শ্রম বাজারে আনা সম্ভব হয়নি। তাদেরও শ্রম বাজারে আনতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের সামাজিক খাতে অনেক ব্যয় করতে হবে। প্রবীণদের দেখাশোনার জন্য বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে। এজন্য অনেক কিছু করণীয় আছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী এক বছরের নিচে ও ৬৫ বছরের ওপর সবাইকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। সবার জন্য স্বাস্থ্য, পুষ্টিসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশ হবে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র, যেখানে প্রবীণরা থাকবেন সম্মানের সঙ্গে নিরাপদ ও আনন্দে।

পিআইডি ফিচার