আগ্রাসী বিনিয়োগে নষ্ট হচ্ছে পুঁজিবাজারের পরিবেশ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ : সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। এ ধরনের বিনিয়োগকারীরা নিজেদের পছন্দসই কোম্পানির শেয়ার সুযোগমতো বাজার থেকে কিনে নেন এবং পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন তথা পরিচালনা পর্ষদে নাম লেখান। এ প্রেক্ষিতে কোনো কোম্পানির শেয়ারের বড় ধরনের লেনদেন হলেই বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির মালিক পক্ষের টনক নড়ে ওঠে। কোম্পানির মালিকানা ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন থাকেন তারা। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে দোলাচলে থাকেন। করপোরেট উদ্যোক্তাদের এ ধরনের আগ্রাসী বিনিয়োগ ‘অনৈতিক’ এবং তা দীর্ঘ মেয়াদে  পুঁজিবাজারের জন্য ‘অশনিসংকেত’ বলে মনে করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

প্রসঙ্গত সম্প্রতি পুঁজিবাজার থেকে এসআইবিএলের বড় অঙ্কের শেয়ার নিয়ে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এর আগে এসআইবিএলের শেয়ার কিনে পরিচালনা পর্ষদে বসতে চেয়েছিল দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপও। সুবিধা করতে না পেরে প্রায় ৩১ শতাংশ শেয়ার কেনার পরও শেষ পর্যন্ত নিজ অবস্থান থেকে সরে যায় ইউনাইটেড গ্রুপ। তারা শেয়ারগুলো এস আলম গ্রপের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা নিয়ে চলে যায়। পরে এই ব্যাংকটিতে ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এদিকে সম্প্রতি ব্লক মার্কেটে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের বড় ধরনের লেনদেন চোখে পড়ছে। গত এক সপ্তাহে এ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫০ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়। একই অবস্থা এবি ব্যাংকের। গতকাল মূল মার্কেট এবং ব্লক মার্কেট উভয় স্থানেই এবি ব্যাংকের বড় ধরনের লেনদেন হতে দেখা গেছে। এদিন মূল মার্কেটে ব্যাংকটির গত দুই বছরের সেরা লেনদেন হয়। হাতবদল হয় তিন কোটি ৩৯ লাখ শেয়ারের। এর পাশাপাশি ব্লক মার্কেটে প্রতিষ্ঠানটির সাত লাখ ৫৬ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়।

একইভাবে মূল মার্কেটে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বড় ধরনের লেনদেন হয়। মাত্র এক হাজার ৩৯ হাওলায় লেনদেন হয় পাঁচ কোটি ৮৩ লাখ শেয়ার। গত দুই বছরে ব্যাংকটির এমন লেনদেন চোখে পড়েনি। সূত্র জানায়, বিশেষ একটি গ্রুপ ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে আসতে চাইছে। এরাই মূলত শেয়ারগুলো কিনছে।

বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিক-বিন আবদুল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি। কথা হয় ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গোলাম মূর্তজার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শেয়ারের দর বৃদ্ধি বা লেনদেন প্রসঙ্গে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।’

‘ব্যাংকটির মালিকানায় পরিবর্তন আসছে কি না’Ñএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এমন কোনো তথ্য পাইনি।’

জানা যায়, করপোরেটদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। ফলে এসব ব্যাংকের দিকে তাদের নজর বেশি। যে কারণে তারা এসব ব্যাংকের মালিকানা পেতে আগ্রহী।

পুঁজিবাজারে করপোরেট উদ্যোক্তাদের এ ধরনের আগ্রাসী বিনিয়োগ অনৈতিক ও পুঁজিবাজারের জন্য স্বার্থবিরোধী বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। আর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা এটাকে পুঁজিবাজারের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন।

তাদের মতে, একটি প্রতিষ্ঠান তিল তিল করে গড়ে তোলেন উদ্যোক্তারা। আর প্রতিষ্ঠানটি যখন উন্নতি করে, বাজার থেকে শেয়ার কিনে অন্য কেউ  প্রতিষ্ঠানটির মালিক হওয়া যাবে বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘যে কেউ হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ঢুকে পড়া পুঁজিবাজারের জন্য ভালো সংবাদ নয়। এতে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো তালিকাভুক্ত হতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়বে। তবে আমি মনে করি, এটা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ যারা মূল স্পন্সর তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ শেয়ার থাকলে মালিকানা হারানোর ভয় নেই।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘উদ্যোক্তাদের সুরক্ষার জন্য বিএসইসির গাইডলাইন জরুরি। বিএসইসি যদি একটি নির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে দেয়, তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও দায়িত্ব রয়েছে। তারা যদি বিএসইসির সঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে, তাহলে একটি উদ্যোক্তা সুরক্ষা গাইডলাইন বের হয়ে আসতে পারে।’

অন্যদিকে করপোরেটদের প্রতিষ্ঠান দখলের প্রতিযোগিতায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ কোনো শেয়ারদর যখন বাড়তে থাকে, তখন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকে পড়েন তারা। ফলে বেশি দরে শেয়ার কিনে নিতে আগ্রহী হোন। কারণ বাজারে তখন এসব শেয়ার নিয়ে নানা গুজব ঘুরে বেড়ায়। যে কারণে কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না তারা। শেয়ার অতিমূল্যায়িত হয়ে গেলে তারাই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘তালিকাভুক্ত যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের অস্বাভাবিক লেনদেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তারা না বুঝে এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করেন। আর সুযোগসন্ধানীরা তাদের কাছে বেশি দরে শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়ে চলে যায়। ফলে শেষ ধাক্কাটি বিনিয়োগকারীদেরই সামলাতে হয়।’