আঙুরের থোকায় রঙিন স্বপ্ন বুনছেন প্রতিবন্ধী দম্পতি

সমাজের অন্য মানুষের মতো দুই হাতে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেন না শরিফুল ইসলাম। ছোটবেলায় গ্রাম্য ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় ১০ বছর বয়সে হারান এক হাত। পরিবারে বোঝা হয়ে থাকতে চাননি তিনি। শারীরিকভবে প্রতিবন্ধী হয়েও একের পর এক চেষ্টা করেছেন নিজেকে স্বনির্ভর করার। এবার সেই স্বপ্ন তার পূরণের পথে। নিজেকে স্বনির্ভর করতে স্ত্রী শারমিনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির আঙিনায় আঙুর ফলের চাষ করে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন এই দম্পত্তি। এখন তাদের বাড়ির বাঁশের মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে সবুজ রঙের রাশিয়ান মিষ্টি জাতের আঙুর। এসব ফল দৃষ্টি কাড়ছে এলাকাবাসী ও দর্শনার্থীর। আঙুরের থোকায় শরিফুল ও মিম দম্পত্তির চোখে এখন রঙিন স্বপ্ন। জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও মাটির বৈশিষ্ট্য না জেনেই শুধুমাত্র ইউটিউব দেখে আঙুর চাষে আগ্রহী হন এই দম্পত্তি।

সরেজমিনে দেখা যায়, তাদের বাড়িতে ঢোকার প্রধান ফটকেই বাঁশ দিয়ে তৈরি আঙুরের মাচা। মাচার দিকে তাকালেই চোখে পড়ে প্রতিটি গাছের ডালে থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর। এই দম্পত্তি আঙুর গাছের পরিচর্যা করছেন। বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা তার আঙুর গাছ দেখতে আসছে। কৃষি উদ্যোক্তা শরিফুল বলেন, আমি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে বাম হাতে আঘাত পাই। স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় পরবর্তী সময়ে হাতটি কেটে ফেলতে হয়। যে কারণে আমি ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। একটি হাত না থাকায় অনেকে কাজেও নেন না। ছোট একটা ব্যবসা ছিল তাতেও কোনো ফল হয়নি। অভাবের সংসারে বসে না থেকে নিজে কিছু করার চিন্তা মাথায় আসে। প্রায় দুই বছর আগে এক ছোট ভাই একটি আঙুরের চারা এনে দেয় বাড়িতে রোপণের জন্য। সেই গাছে পর্যাপ্ত ফল আসে এবং ফল অত্যন্ত মিষ্টি হয়। সেই থেকে আমার ইচ্ছা ছিল মিষ্টি আঙুর চাষ করার। তখন ইউটিউবে অস্ট্রেলিয়ার একটি আঙুরের একটি ভিডিও দেখে মিষ্টি আঙুরের চারা খুঁজতে থাকি। দেড় বছর আগে আমার ওই ভাইয়ের মাধ্যমে ভারতে যোগাযোগ করে সেখান থেকে ৮টি চারা এনে বাড়িতে লাগাই। চারা লাগানোর ৭ মাসে ফলন পাই। ওই গাছে পর্যাপ্ত আঙুর ধরেছিল এবং ফল খুব মিষ্টি ছিল। তখন চিন্তা করি এর প্রসার বাড়ানোর এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করার। ইতোমধ্যে আমি ছয় কাঠা জমি আঙুর চাষ করেছি। ভারত থেকে আরও অন্যান্য জাতের চারার অর্ডার দিয়েছি। আমার এখানে তিনটি জাতের মোট ৩৪টি গাছ রয়েছে। ২২ হাজার টাকা ব্যয় করে বর্তমানে যে পরিমাণ ফল গাছে আছে সবকিছু ঠিক থাকলে আল্লাহর রহমতে ১৫ থেকে ২০ মণ ফল বিক্রি হবে, যা দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই আমি পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারই সফল হয়েছি। আমার আঙুর অত্যন্ত মিষ্টি। ইতোমধ্যে আমি গাছ থেকে চারাও তৈরি করছি। আমি কখনও আমার আঙুর গাছে ওষুধ কিংবা কোনো রাসায়নিক সার ব্যবহার করিনি। বিষমুক্ত ফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেব এটাই আমার ইচ্ছা।

শরিফুলের স্ত্রী শারমিন আক্তার মিম বলেন, দেশের মাটিতে অনেক ফল চাষ হতে দেখে আঙুরও চাষ হতে পারে এটা মাথায় আসে। আমরা ইউটিউব দেখে আঙুরের পরীক্ষামূলক চাষ করে সফল হয়েছি। একটা সময় আমরা এমন একটা দিনের ভেতর দিয়ে পার করেছি যা বলে বোঝানো যাবে না। অভাবের সংসারে নিজেরা কিছু করার চিন্তা সবসমই মাথায় ঘুরপাক খায়। আমার বাচ্চা যখন ছোট তখন আঙুর কি জিনিস সে চিনত না। কারও হাতে দেখলে বলতো মা এটা কি। সেই কষ্ট নিয়েই এই চাষ শুরু করেছি। এখন আমাদের একটি আঙুর বাগান হয়েছে। আমার স্বামী একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। একটি হাত না থাকার কারণে তিনি কোন কাজ করতে পারে না। দুজনে কিছু করার চিন্তা নিয়েই এই চাষ শুরু করি। আল্লাহর রহমতে এবার প্রচুর ফলন হয়েছে। আশা করি, আমরা এবার সফল হবো।
শরিফুলের বন্ধু রাশেদ ও প্রতিবেশী জাহিদ বলেন, আমরা জানতাম আঙুর বিদেশি ফল। কিন্তু আমাদের দেশের মাটিতেই আঙুর চাষ হচ্ছে। এই আঙুরটি বাজারের আঙুর থেকেও বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এসে দেখছে, আঙুর ফল খেয়ে সুনাম করছে। আমরাও শরিফুলের দেখাদেখি আঙুর ফল চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।

মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, শিবপুর গ্রামের শরিফুল ইসলাম পরীক্ষামূলকভাবে তার বাড়ির আঙিনায় আঙুর চাষ করেছে। সব দিক বিবেচনা করে দেখা যাচ্ছে মেহেরপুরের মাটি ও আবহাওয়া আঙুর চাষের জন্য উপযুক্ত। শরিফুলের উৎপাদিত আঙুর স্বাদে খুব মিষ্টি। এলাকার লোকজন তার বাগান দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। আশা করছি, শরিফুলের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আশপাশের যারা বেকার যুবক রয়েছেন তারা আঙুর চাষে উদ্বুদ্ধ হবেন। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।