রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, সুরকার ও সংগীতপরিচালক আবদুল আহাদ। রাজশাহী শহরে জন্ম হলেও তার পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ফুকুরহাটি গ্রামে। বাবা আবদুস সামাদ খান ও মা রহমতুনেসা। বাবা ও মাতামহ খানবাহাদুর মোহাম্মদ সোলায়মান দুজনেই তৎকালীন শিক্ষা বিভাগে চাকরি করতেন। আবদুল আহাদ শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যয়নকালে ওস্তাদ বালি ও ওস্তাদ মঞ্জু সাহেবের কাছে তিনি উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিম নেন। সে সময় তিনি কলকাতা বেতারে সংগীত পরিবেশনের জন্য মনোনীত হন এবং বাংলা ঠুংরি পরিবেশন করেন। ১৯৩৬ সালে অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে ঠুংরি ও গজল প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে সংগীতজগতে তার আসন সুদৃঢ় করেন। ১৯৩৮ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তখনকার দিনে তার এ ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসদীপ্ত, কারণ তখন এদেশের মুসলিম সমাজে সংগীতের তেমন প্রচলন ছিল না। শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের একটি অনুষ্ঠানে ‘দিনের পর দিন যে গেল’ গানটি গেয়ে তিনি কবিগুরুর আশীর্বাদ লাভ করেন। সেখানে তার সহপাঠীদের অন্যতম ছিলেন পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসংগীতের কিংবদন্তিতুল্য গায়িকা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তিদেব ঘোষ ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার ছিলেন তার সংগীত শিক্ষাগুরু। শান্তিনিকেতনে অবস্থানকালে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহাশীষ লাভে ধন্য হয়েছিলেন।
শান্তিনিকেতনে চার বছর অধ্যয়নশেষে ১৯৪১ সালে তিনি কলকাতার এইচএমভি (হিজ মাস্টার্স ভয়েজ) কোম্পানিতে সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার পরিচালনায় পঙ্কজকুমার মল্লিক ও হেমন্তকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেছেন।
আবদুল আহাদের একটি বড় কীর্তি এদেশে আধুনিক গান ও দেশাত্মবোধক গানের গোড়াপত্তন করা। তিনি ছায়াছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। দুঃখে যাদের জীবন গড়া, আসিয়া, নবারুণ ও দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও ছায়াছবির সংগীত পরিচালনায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। সুরকার, প্রশিক্ষক ও সংগঠক হিসেবে ঢাকার সংগীতজগতে আবদুল আহাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশভাগের ফলে ঢাকার সংগীতজগতে শিল্পীর যে শূন্যতা দেখা দেয়, আবদুল আহাদ নতুন নতুন শিল্পী সৃষ্টির মাধ্যমে সে শূন্যতা পূরণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রায় দু’যুগ বেতারের ‘সংগীতশিক্ষার আসর’ পরিচালনা করেন এবং এর মাধ্যমে বেতারের সংগীতজগৎকে সংগঠিত ও সমৃদ্ধ করেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি একাধিকবার রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হন। পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৬২ সালে তমঘা-ই-ইমতিয়াজ, ১৯৬৯ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ এবং বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করে। তিনি বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা কেন্দ্রের ‘মুখ্য সংগীত প্রযোজক’ হিসেবে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন। অকৃতদার আবদুল আহাদ রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। [সংগৃহীত]