মৃতদেহ স্পর্শই যেখানে ধর্ম ও জাতি নাশের সম্ভাবনা, সেখানে শব ব্যবচ্ছেদ ছিল অকল্পনীয়। এ কাজে প্রবৃত্ত হওয়া মানে সমাজচ্যুতি, একঘরে হওয়া। জাতের নামে তখন চলছিল বজ্জাতি। সেসব কুসংস্কারের কঠিন বর্ম টুকরো টুকরো করে দিতে এগিয়ে এসেছিল সেই উনিশ শতকের প্রথম দিকে পাঁচজন বাঙালি তরুণ ছাত্র ও শিক্ষক। সমাজের সব ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে সেদিন যে সাহসের পরাকাষ্ঠ দেখিয়েছিলেন তারা, তার ফল বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে সৃষ্টি করেছিল যুগান্তকারী ঘটনা। আর সেই পথ ধরেই বিকশিত হয়েছে উপমহাদেশের চিকিৎসাশাস্ত্র এবং সেই সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞান।
১৮৩৬ সালের ২৮ অক্টোবর, আজ থেকে ১৮৭ বছর আগে বঙ্গদেশে প্রথম ঘটেছিল চিকিৎসাক্ষেত্রে শব ব্যবচ্ছেদ। বাংলার তৎকালীন রক্ষণশীল গোষ্ঠীর, ছিল যারা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাদের নাকের ডগায় শব ব্যবচ্ছেদবিদ্যা চালু করা বৈপ্লবিক ঘটনা বৈকি। এই যুগান্তকারী ঘটনাকে স্বাগত জানাতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা কামান ও তোপ দেগেছিল। চার বাঙালি যুবক ও তাদের বাঙালি শিক্ষক মিলে বঙ্গীয় হিন্দু ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হাতেকলমে শব্দ-ব্যবচ্ছেদ করে বহুবর্ষ লালিত একটি কুসংস্কারের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে এসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন। বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিক ১৮৩৫ সালের ২৮ জানুয়ারি কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিপত্র জারি করেন। ১৮৩৫ সালের ২০ ফেব্রু ফেব্রুয়ারি থেকে ভর্তি শুরু হয় এবং ৫০ জন ছাত্র নিয়ে ১ জুন ১৮৩৫ থেকে ক্লাস শুরু হয়। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ডা. মাউন্টফোর্ড জোসেফ ব্রামলি, এনাটমি বিভাগের প্রধান হিসেবে ডা. হেনরি হ্যারি গুডিব, মেডিসিনে ডা. টাইটেলার যোগ দেন। বাঙালি মধুসূদন গুপ্তও যোগ দেন এনাটমি ও সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডেমোনেস্ট্রেটর হিসেবে। প্রথম ব্যবচ্ছেদের দু’বছরের মধ্যে শব ব্যবচ্ছেদ শিক্ষায় বেঙ্গল কলেজের ছাত্রদের অসাধারণ উন্নতি দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হয়েছিলেন ডা. হেনরি। ১৮০০ সালে হুগলিতে জšে§ছিলেন মধুসূদন গুপ্ত। প্রথম জীবনে সংস্কৃত কলেজের বৈদক শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হয়েছিলেন, মেধার গুণে। তিনিই প্রথম হিন্দু; যিনি সমাজের সংবিত ফেরাবার তাগিদে কুসংস্কারকে ভ্রুকুটি প্রদর্শন করে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেন মেডিকেল কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে দাঁড়িয়ে। তার অবদান ও বিস্মৃত হওয়ার নয়। সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে চিকিৎসাশাস্ত্রের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল বঙ্গদেশসহ উপমহাদেশে। ১৮৫৬ সালের ১৫ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
[ সংগৃহীত]