অনিল মো. মোমিন : জল্পনা-কল্পনা আর নাটকীয়তা শেষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত হলো। ২১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের ‘আজীবন বহিষ্কার’ ঘোষণার মাধ্যমে দেশবাসী র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখতে পেল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গত ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের গণরুমে নবীন ছাত্রী ফুলপরীকে রাতভর র্যাগিং, শারীরিকভাবে নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে এ নির্মমতা চালান শাখা ছাত্রলীগের নেত্রী ও তার অনুসারীরা। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় কোনো ঘটনা হিসেবে ফুলপরীর ঘটনা দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশি ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম, সচেতন মহল, নারী সংগঠনসহ নানান অঙ্গন সোচ্চার হয় ওই ঘটনায়।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিবেচনায় ‘আজীবন বহিষ্কার’ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তথা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে শান্তিকামী শিক্ষার্থীদের কাছে। এমন শাস্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং বন্ধে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। র্যাগিংয়ের মতো ঘৃণ্য কাজ বন্ধ করতে, এর প্রভাব কমাতে এমন একটি শাস্তি উদাহরণ হয়ে থাকবে। দেশ ও জাতির জন্য নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার আকাশচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসে নবীন শিক্ষার্থীরা র্যাগিংয়ে যে শারীরিক ও মানসিক অপমান, নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার হয়, তা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হয়ে কেউ জীবন হারিয়েছে, কেউ পড়াশোনা ছেড়েছে, কেউ দীর্ঘস্থায়ী মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কয়েকটি আলোচিত র্যাগিং-কাণ্ডের দিকে আলোকপাত করলে তা সহজেই বোঝা যাবে। ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নবীন শিক্ষার্থী ‘বড় ভাইদের’ হাতে শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। এর প্রভাব এত অনাকাক্সিক্ষত ছিল যে, সে নিজের বাবা ও আত্মীয়স্বজনকেও চিনতে পারছিল না। ২০১৬ সালে ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা মৃত্যুবরণ করে। পরিবারের ভাষ্যমতে, ওই মৃত্যুর পেছনেও র্যাগিং অনুঘটক ছিলো- প্রায় রাতে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে হাফিজুর ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ফুলপরীর ঘটনার পরেও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাকিয়া সুলতানা জয়া র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে রিয়াদ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যম উঠে এসেছে।
র্যাগিং ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে; যা জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনে। ক্ষতির বিষয়টি বুঝতে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আহমেদ হেলালের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এক গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া ব্যক্তি তিন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেনÑ এক. তারা উদ্বিগ্নতা ও বিষণœতায় ভোগেন এবং আত্মবিশ্বাস কমে যায়। দুই. ব্যক্তিত্বের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ভবিষ্যতে তাদের সামাজিক দক্ষতা কমে যায়। তিন. যারা র্যাগিংয়ের মুখোমুখি হন, ভবিষ্যতে তারাও অন্যকে র্যাগ দিয়ে থাকেনÑ তা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে। মোটকথা তাদের মধ্যে একটি ‘নিপীড়ক’ তৈরি হয়।”
এমন বাস্তবতায় শূন্য সহনশীলতায় র্যাগিংয়ের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। স্বীকার করতে হবে, যথোপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায়ই র্যাগিং বর্বরতা ক্রমেই ভয়ংকর হচ্ছে। নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের নামে অর্ধনগ্ন করে শৌচাগারে সেলফি তুলতে বাধ্য করা, দিগম্বর করা, শারীরিক অত্যাচার চালিয়ে তার ভিডিওচিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া, বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেয়া, অশ্লীল কর্মকাণ্ড করানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেয়ানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানো প্রভৃতির মতো ন্যক্কারজনক ও প্রাণনাশের ঝুঁকিমূলক কর্মকাণ্ডের চর্চা বাড়ছে। আবার বিচার চাইতে গেলেও পুনর্বার এসব ঘটনার শিকার হতে হয়। এ বছর রাজধানীর ইডেন কলেজের এক ছাত্রী র্যাগিংয়ের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ করায় অভিযুক্তরা তাকে স্ট্যাম্প দিয়ে মারধর করে, জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলে, চুল ছিঁড়ে ফেলে, বঁটি দিয়ে মারতে উদ্যত হন। র্যাগিংয়ের কঠোর শাস্তির নজির থাকলে অপরাধীরা জঘন্য নিপীড়িন চালানোর আগে দুই বার ভাবতো। র্যাগিং একটি অপরাধ। এটার শাস্তিও দিতে হবে ওই দৃষ্টিকোণ থেকে। হীন বর্বরতার অপরাধে অভিযুক্তদের সতর্ক করা, তিরস্কার করা, সাময়িক বহিষ্কার করা কোনো বিবেচনায়ই যথেষ্ট শাস্তি হতে পারে না। সাধারণত অভিযুক্তরা ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী হওয়ায় স্বল্প মাত্রার এসব শাস্তি অপরাধ দমনে তেমন সহায়কও নয়। ফলে ভিকটিম ব্লেইমিং বাড়ছে। ফুলপরীর বেলায়ও এটি দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে শিবির অ্যাখ্যা দিয়ে প্রশাসনে সোপর্দ করার ঘটনা কয়েকবার ঘটেছে। একই ধরনের ঘটনা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ঘটেছে।
উপর্যুপরি প্রেক্ষাপট ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিবেচনায় ফুলপরীর ঘটনায় অভিযুক্তদের আজীবন বহিষ্কার একটি যথোপযুক্ত শাস্তি। ঘটনার যে তীব্রতা তাতে স্পষ্ট যে অভিযুক্তদের স্বল্প সাময়িক শাস্তি যথেষ্ট নয়। ভয়াবহ অপরাধের পরেও যদি সাময়িক বহিষ্কারাদেশ কাটিয়ে পড়ালেখার সুযোগ পেত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতিতে বিপথগামী, সুযোগসন্ধানী, হুকুমের গোলাম কিংবা হীন স্বার্থ চরিতার্থকারী শত শত কর্মী-সমর্থক এ ধরনের অপরাধ ঘটাতে দ্বিতীযবার ভাবত না। অপরাধ করার আগে এখন একবার অন্তত ভাববে। আশা করা যায়, অভিযুক্ত পাঁচজনকে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই অন্তত আগামী পাঁচ বছরে ৫০০ বিপথগামী রাজনৈকিত কর্মী, র্যাগিংকারীর অপরাধে লাগাম টানবে। যে কোনো ছুতায় আগ্রাসী হওয়ার মনোভাবে ভাটা পড়বে। এতে ভবিষ্যতে অন্তত ৫০ জন ফুলপরীকে রক্ষা করা যাবে। সারাদেশে এর ইতিবাচক প্রভাব থাকবেই। আলোচিত এ ঘটনায় আজীবন বহিষ্কার না হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ আরও উসকে যেত। অভিযুক্তদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হতো এসব অপরাধে তেমন কিছুই হয় নাÑএ সাময়িক বহিষ্কার আর কি! বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যেতে পারলে নানা উপায়ে বিশেষ সুবিধা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে ঠিকই বের হওয়া যাবে। এখন অন্তত এ চিন্তা রোধ হবে। কিছু বিষয় থাকে যেগুলোর দৃষ্টান্ত রাখতে হয়। ফলে এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দরকার ছিল।
তবে এ সিদ্ধান্তের জন্য হাইকোর্টের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাওয়া হতো না। ওই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ফুলপরীর ঘটনায় পুরো দেশেই একটা ঝাঁকি খেয়েছে। তখন সবাই আশা করছিল অপরাধীরা একটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে, যা সারাদেশের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া
ধীরে চলো নীতিতেই এগোচ্ছিল। ‘জাস্টিস ইজ ডিলাইড জাস্টিস ইজ ডিনাইইড’Ñএ রকম অভিপ্রায় থেকেই সম্ভবত অনাগ্রহ ছিল ত্বরিত ও যথার্থ প্রদানে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের ছাড় দিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোড অব কন্ডাক্টের বিধি প্রথম ভাগের ৪, ৫, ৭ ধারা বিবেচনায় না নিয়ে শুধু দ্বিতীয় ভাগের ৮ অনুযায়ী এক বছরের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছিল একটা বড় প্রহসন। সর্বশেষ হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হলো।
কারও কারও কাছে মনে হতে পারে র্যাগিং-কাণ্ডে আজীবন বহিষ্কারের শাস্তি বেশি হতে পারে কিংবা অভিযুক্তদের পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারে বড় ঝামেলা হতে পারে। আদতে বিষয়টি এমন কিছুই না। আদালত অনেক কিছু বিবেচনায় নিয়েই ঘটনার তীব্রতায় ঠিক করে কোন শাস্তিটা কোন অপরাধের সঙ্গে উপযুক্ত। ফুলপরীর এ ব্যাপারেও আদালত যথেষ্ট বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত চেয়েছে। তাছাড়া অভিযুক্তরা শাস্তি পেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা না করাও উত্তম বলা যায়। একটা শাস্তির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ওদের ক্যাম্পাসে স্বাভাবিক জীবনযাপনে বেগ পেতে হতো। কেননা ওরা চিহ্নিত থাকতো ক্যাম্পাসে। ওদের প্রতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকত আলাদা। হয়তো এতে মানসিক যাতনার মধ্য দিয়ে গিয়ে আত্মহননের মতো ঘটনাও ঘটতে পারত। কিংবা ওরা আগের তুলনায় আরও খারাপ হতো। প্রতিশোধপরায়ণ হতো যেটা ফুলপরী কিংবা অন্য কোনো শিক্ষার্থীর জন্য একদমই নিরাপদ হতো না। তাই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশে অনেক সুযোগ আছে পড়ালেখার। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ায় আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সব শিক্ষার্থীকে নিজ শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হতে হবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়