আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়াতে জোরারোপ

নিজস্ব প্রতিবেদক: ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশলগত স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং এখানকার বাণিজ্য সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বিষয়ক নীতিমালার সংস্কার ও সহায়ক নীতি প্রণয়ন, পণ্য বহুমুখীকরণ, কর ও শুল্ক কাঠামোর আধুনিকায়ন, অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, ক্রস বর্ডার বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি একান্ত অপরিহার্য বলে মত প্রকাশ করেছেন ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এবং বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আলোচকরা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) যৌথ আয়োজনে ‘বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ২০২১’ শীর্ষক সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলনের চতুর্থ দিন গতকাল ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এবং বাংলাদেশ: অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া প্রধান অতিথি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন। এছাড়া বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নায়োকি সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন।

ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার এবং বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৫০ শতাংশই আসে এ অঞ্চলের দেশগুলো থেকে। তিনি উল্লেখ করেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে ২০২১ সালে ২৩৯ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে। মূলত খাদ্য, কৃষি, ফিশারিজ, কেমিক্যাল, টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, সিমেন্ট, নির্মাণ, টেলিকম, ইন্স্যুরেন্স, ব্যাংকিং প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রবেশদ্বার বাংলাদেশ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে আমাদের এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের বেসরকারি খাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বেসরকারি খাত থেকে উত্থাপিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বিষয়ক প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে সরকার অবগত রয়েছে। সেগুলো দ্রুত নিরসনে সরকার বদ্ধপরিকর। তোফাজ্জল হোসেন বলেন, সরকার দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার করেছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে শিল্পকারখানার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে। তিনি টেকসই অবকাঠামো উন্নয়নে জোরারোপ করেন।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, সরকারের ক্রমাগত নীতি সহায়তার ফলে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোয় তা অব্যাহত থাকবে। ইআরডি সচিব জানান, দেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে এরই মধ্যে মেগা প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি দেশের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর করেছে এবং ১০টি দেশের সঙ্গে পিটিএ ও এফটিএ স্বাক্ষরের জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অতি দ্রুতই দুটি দেশের সঙ্গে পিটিএ স্বাক্ষর হবে।

সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে ইতো নায়োকি বলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তিন হাজার ডলারে পৌঁছাবে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়বে এবং বাণিজ্য ও সেবার খাতের সম্প্রসারণের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ওয়েবিনারে নির্ধারিত আলোচনায় পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ, এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, নিটল-নিলয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ, এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির এবং ইউএনঅ্যাসক্যাপের ডেপুটি হেড ও সিনিয়র ইকোনমিক অফিসার ড. রজন সুরেশ রতœা প্রমুখ অংশ নেন।

ড. রজন সুরেশ রত্না বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে শুধু একটি পণ্য ও এক  অঞ্চলের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভরতা এলডিসি উত্তরণের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলতে পারে। তাই রপ্তানি পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণ অতীব আবশ্যক। তিনি বলেন, ইউরোপের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রচুর খরচ বহন করতে হয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়া-অঞ্চলের দেশগুলোয় আরও বেশি হারে পণ্য রপ্তানির ওপর নজর দেয়া আবশ্যক। আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে তিনি অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, ক্রস বর্ডার যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে মত প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় প্রয়োজনীয় অনুমোদনপত্র প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা ও জটিলতা নিরসনের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, বৃহৎ জনগোষ্ঠীই আমাদের প্রধান শক্তি, যা কাজে লাগতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণে আরও মনোযোগী হতে হবে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোকে বিদেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ দিতে হবে। তিনি যথাসময়ে নীতিমালার বাস্তবায়ন ও নীতিমালার সহজীকরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে এনবিআর পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রদান, ঢাকা বিমানবন্দরে পণ্য আদান-প্রদানে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও দ্রুতকরণ এবং বিমান বাংলাদেশের সেবার আধুনিকায়নের ওপর জোরারোপ করেন।

আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তা কাজে লাগাতে পার্টনারশিপ ও গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে উন্নয়ন দরকার, যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে এবং পণ্য উৎপাদনে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে।

ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, সারা পৃথিবীর ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বসবাস করে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের মোট জিডিপির ৫০ শতাংশ আসবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে। এ অবস্থায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের বৃহৎ ও সম্ভাবনাময় বাজার ধরতে আমাদের সরকার ও উদ্যোক্তাদের আরও কৌশলী হতে হবে।