নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: মজুরি কাঠামো ২০১৬-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ আট দাবিতে আবারও আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন। গতকাল চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন এ ঘোষণা দেন। দাবি আদায়ে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে সংগঠনটি। না হলে আগামী ছয় এপ্রিল থেকে কর্মবিরতি শুরু করা হবে।
দাবিগুলের মধ্যে রয়েছে মজুরি কাঠামো ২০১৬-এর আওতায় ৭৫ শতাংশ শ্রমিকের বেতন বকেয়া এখনও অনাদায়ী থাকা, ভারতে আটক চারটি লাইটার জাহাজের আট শ্রমিককে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা, ক্রমাগত নির্যাতন বন্ধ করা, মাস্টার বা ড্রাইভাবের মান উন্নয়ন, চট্টগ্রাম ও মংলায় ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন, শ্রমিক নেতাদের মতামত মূল্যায়ন ও নৌ বিভাগের চাকরিতে বাস্তব অভিজ্ঞাতা আছে এমন শ্রমিকদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ উল্লেখ্যযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনের জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি হওয়া পণ্যের ৭০ শতাংশই লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বহির্নোঙরে খালাস করা হয়। প্রতি বছর বহির্নোঙর দিয়ে পণ্য পরিবহন বাড়লেও সে হারে বাড়ছে না লাইটার জাহাজের সংখ্যা। অথচ এ লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকদের মজুরি কাঠামো ২০১৬ এর আওতায় ৭৫ শতাংশ শ্রমিক এখনও বকেয়া বেতন অনাদায় রয়েছে, যা আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে না আসে তাহলে বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সব শ্রমিকরা আগামী ছয় এপ্রিল হতে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) এর অধীনে প্রায় এক হাজার ৭০০ জাহাজের প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মবিরতি পালন শুরু করবে। এ কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ১৭টি ঘাটে পণ্য ওঠানামা বন্ধ থাকবে। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীপথে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হবে। পাশাপাশি গত দেড় বছর ধরে ভারতে আটক চারটি লাইটার জাহাজের আট শ্রমিককে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর যদি তাদের মুক্তি না হলে ভারত রুটে চলাচলকারী সব জাহাজের শ্রমিকগণ কর্মবিরতি পালন করলে তার দায় সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের নিতে হবে।
এ সংবাদ সম্মেলনের আরও উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি হাজী শেখ মোহাম্মদ ইছা মিয়াসহ অন্য সম্পাদকবৃন্দ। তারা বলেন, মালিকেরা সরকারকে চাপ দিয়ে ভাড়া বৃদ্ধি করে নেন শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন পরিশোধ করবেন বলে। তারপরও মালিকগণ তাদের চরিত্র পরিবর্তন না করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। যা শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন পরিশোধ না করে মালিকগণ চাচ্ছেন সারা দেশের নৌ শ্রমিকরা আন্দোলন করুক। কিন্তু আমরা কখনও তা চাই না। তিনি মালিকদের প্রতি আহ্বান রেখে বলেন, নৌ শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন এরিয়াসহ প্রদান না করা হলে শ্রমিকগণ নিজ নিজ কর্মস্থলে কর্মবিরতি করলে তার দায়দায়িত্ব আপনাদেরই নিতে হবে।
ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) ও শিল্প মালিকদের তথ্য অনুযায়ী, বন্দর থেকে নদীপথে পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য জাহাজ আছে ৯২৯টি। এর মধ্যে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের আওতাধীন ৪৫০ জন মালিকের জাহাজ আছে ৭৫০টি। এর বাইরে ১১টি শিল্প গ্রুপ নিজেদের পণ্য পরিবহনের জন্য ১৭৯টি জাহাজ পরিচালনা করছে। আর এসব লাইটার জাহাজের মাধ্যমে খালাস হয় এমন পণ্যের মধ্যে রয়েছে গম, ডাল, ভুট্টা, সার, অপরিশোধিত চিনি, ক্লিংকার, কয়লা, রড তৈরির কাঁচামাল, পোলট্রি খাদ্যসহ শিল্পপণ্যের কাঁচামাল ইত্যাদি। বর্তমান পরিস্থিতিতেই আমদানি বেড়ে গেলে লাইটার জাহাজের সংকট দেখা দেয়।
লাইটার জাহাজের সংকট তীব্র হওয়ার কারণে গত কয়েক বছর ধরে পণ্য আমদানিকারকদের বাড়তি মাশুল গুনতে হচ্ছে। কারণ বন্দরের বহির্নোঙরে আসা বড় জাহাজগুলোকে নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস করতে হয়। আর নির্ধারিত সময়ে পণ্য খালাস করতে না পারলে প্রতিদিনের জাহাজ ভাড়া বাবদ ক্ষতিপূরণ গুনতে হয় আমদানিকারকদের। জাহাজ ভেদে প্রতিদিনের এ ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। দেশের ইস্পাত খাতের মার্কেট লিডার বিএসআরএম। এ প্রতিষ্ঠান গত বছর সময়মতো বাড়তি সিডিউল না পাওয়ায় আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হয় ৬০ কোটি টাকা। এছাড়া আমদানিকৃত কাঁচামাল সময়মত খালাস করতে না পারায় রড, সিমেন্টসহ বেশ কিছু উৎপাদন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
আমদানিকারকরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের প্রয়োজনীয় লাইটারেজ জাহাজের অভাবে মাদার ভ্যাসেলগুলো সময়মতো পণ্য খালাস করতে পারছে না। বহির্নোঙরে ৪০টির মতো মাদার ভ্যাসেল আমদানিকৃত লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে অপেক্ষা করছে। প্রতিটি জাহাজেরই রয়েছে পণ্য খালাসের তাড়া। অন্যদিকে গুদাম ভাড়ার চেয়ে লাইটারেজ জাহাজের ভাড়া কম হওয়ায় বহু আমদানিকারক জাহাজকেই গুদামের মতো ব্যবহার করছেন। এ নিয়ে আমরা আমদানিকারকরা বিপাকে আছি। আর এসবের মধ্যে যদি লাইটারেজ জাহাজ শ্রমিকরা কর্মবিরতি পালন করে, তাহলে তো পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। কারণ, সামনে রমজান আসছে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা ও দাবি মেনে নেওয়া। তা না হলে এর দায় সাধারণ মানুষকে বহন করতে হবে। এটা কাম্য নয়।
উল্লেখ যে, বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া পণ্যবাহী বড় জাহাজ বহির্নোঙরে নোঙর করানো হয়। বড় জাহাজ বন্দর জেটিতে ভিড়তে না পারায় বহির্নোঙরে এসব জাহাজ থেকে পণ্য স্থানান্তর করে ছোট জাহাজে রাখা হয়। এর পর এসব ছোট জাহাজ সারা দেশের ৩৬টি ঘাট অঞ্চলে পণ্য নিয়ে যায়। পণ্য পরিবহনের জন্য আমদানিকারকদের লাইটার জাহাজ বরাদ্দ দেয় ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)। এর বাইরে শিল্প মালিকদের নিজস্ব জাহাজেও পণ্য পরিবহন করা হয়।