Print Date & Time : 8 July 2025 Tuesday 5:56 am

আট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬০ শতাংশের বেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে এ খাতে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে ব্যাংক খাতের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে। যার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ৮টি ব্যাংকের খেলাপি ৬০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত গ্রুপগুলোর নামে-বেনামে যেসব ঋণ ছিল, তার প্রকৃত চিত্র এখন দেখাতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। যার কারণে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। দেশের ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ ঋণ বেনামি, যা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেয়া হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৬০ শতাংশের ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। এর মধ্যে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ ৯৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ৯০ দশমিক ৭২ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৮৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ৭২ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬২ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে।

এছাড়া ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১৫টি ব্যাংকের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ২৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১২ দশমিক ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে অবস্থান করছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকে লভ্যাংশ বিতরণের ওপর বিধিনিষেধ দিয়ে আসছে। এত দিন কেবল প্রভিশন সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধা নেয়া ব্যাংকের লভ্যাংশ বিতরণের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ ছিল। এবার নতুন করে অনেক ধরনের শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি হলে লভ্যাংশ দিতে পারবে না।
নতুন নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, একটি ব্যাংক কেবল বিবেচ্য পঞ্জিকাবষের্র মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ দিতে পারবে। কোনোভাবেই পুঞ্জীভূত মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করা যাবে না। ঋণ, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে কোনো ধরনের সংস্থান ঘাটতি থাকা যাবে না। আবার সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতির কারণে আরোপিত দণ্ড সুদ ও জরিমানা অনাদায়ী থাকলে লভ্যাংশ দিতে পারবে না। প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডেফারেল সুবিধা বহাল থাকা অবস্থায় লভ্যাংশ দেয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২২ ও ২৪ ধারা যথাযথ পরিপালন করতে হবে। এছাড়া আরও বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন নীতিমালার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ১০ শতাংশের বেশি এমন ব্যাংকগুলো লভ্যাংশ দিতে পারবে না। আমরা রেগুলার যে সিএল শিট তৈরি করি, নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে সেটি বিবেচনা করা হবে না। কারণ সিএল শিটের তথ্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই বাংলাদেশ ব্যাংকে দিয়ে থাকে। তখন খেলাপি কম দেখানোর একটা প্রবণতা থাকে ব্যাংকগুলোর। এজন্য লভ্যাংশ দেয়ার নতুন নীতিমালা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর খেলাপি চিহ্নিত করতে বিশেষ পরিদর্শন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
এদিকে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এর মানে গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।