আত্মহত্যা কোনো সমস্যারই সমাধান নয়

মিফতাহুল ইসলাম:আত্মহত্যা সামাজিক ব্যাধি। দিন দিন সমাজের কিছু মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ একাংশ ক্রমেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে, যা বর্তমানে এক মহামারির আকার ধারণ করেছে। যার ফলে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অপার কিছু সম্ভাবনাময় মানুষ। মূলত মানসিক চাপ, হতাশা, একাকীত্ব  প্রভৃতি কারণে মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে।

কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াকেই আত্মহত্যা বলে। বিভিন্ন ধর্মমতে আত্মহত্যা হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ। প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর সারাবিশ্বে যেসব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশেও আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার কারণে যেসকল লোকদের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায় তাদের মধ্যে দশমিক ৬ শতাংশ বাংলাদেশি।

মানুষ যেসব কারণে আত্মহত্যা করে তার বেশিরভাগ কারণই মানসিক। যেমনÑ হতাশা, বিষণœতা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক চাপ ইত্যাদি। সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, বিপদে ধৈর্যধারণের অভাব, আবেগ নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা ইত্যাদি বিষয়ও আত্মহত্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন মানসিক রোগ যেমন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি কখনও কখনও মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়া মানুষ যখন হতাশা, অসহায়ত্বের অপ্রতিরোধ্য অনুভব করে তখন তারা আত্মহত্যাকে তাদের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির একমাত্র বাঁচার উপায় হিসেবে দেখে। বিভিন্ন সম্পর্কের মাঝে দ্বন্দ্ব বা সম্পর্কের টানাপোড়েন, প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছেদ প্রভৃতি কারণেও মানুষ আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। এছাড়া দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক মন্দা, দুরারোগ্য রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি ইত্যাদিও মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে।

আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আগেই বলা হয়েছে যেসব কারণে আত্মহত্যা করা হয় তার অধিকাংশই মানসিক। মানসিক সুস্থতা, মেন্টাল সাপোর্ট ইত্যাদি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে অনেকাংশই আত্মহত্যার প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য মানুষের মাঝে এ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে আবশ্যক। এছাড়া সমাজে বসবাসরত মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা নিশ্চিত করা জরুরি। একাকিত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যেই সুস্থ সম্পর্ক বিকাশে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তিকে কাউন্সেলিং, থেরাপি প্রভৃতি মানসিক চিকিৎসা দ্বারা সুস্থ করে তোলা সম্ভব। কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যা মোকাবিলা করার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব^ দূরীকরণ, হতাশাগ্রস্ত মানুষকে গুণগত সময় দেয়া, তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে সাহায্য করা ইত্যাদির মাধ্যমে আত্মহত্যা ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে ফেলা সম্ভব।

ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি মানুষকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করতে ভূমিকা পালন করে। সব ধর্মমতে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ, গর্হিত এক অপরাধ। অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারটি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। কিন্তু এমনটা করা মোটেও ঠিক নয়।  উদাহরণস্বরূপ ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলা হয়, যে ইসলামকে অন্তর থেকে ধারণ করে সে সামান্য বা বড় যে কারণেই হোক না কেন আত্মহত্যা করতে পারে না। কেননা, আল্লাহ পবিত্র কোরআনেই বলেছেন,”অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে সুখ। (সুরা ইনশিরাহ) পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, ধৈর্য রেখে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে সামনে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। খারাপ সময় চিরদিন থাকে না মানুষের। অন্ধকারের পরেই আলো আসে।

মহান আল্লাহ আরও বলেন, নিশ্চয়ই আমি মানুষকে কষ্ট ও পরিশ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি। (সুরা বালাদ-০৪)। আল্লাহ কাউকেই তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না। (সুরা বাকারা-২৮৬)। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে, আল্লাহই তাদের ঝামেলা ও অশান্তি থেকে বেরোনোর পথ বের করে দেন। আর অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে জীবনোপকরণ দান করেন। যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট। (সুরা তালাক-২, ৩)।

এমন অসংখ্য অনুপ্রেরণামূলক আয়াত পবিত্র আল-কোরআনে আছে, যা চিরন্তন সত্য। কোনো মুসলিম তার ধর্ম ইসলামকে ধারণ করতে পারলে, আত্মহত্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবে। এছাড়া আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য পবিত্র কোরআনে ভয়াবহ শাস্তির কথাও বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে আত্মহত্যা করবে তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সুরা আন নিসা আয়াত-২৯, ৩০)। ইসলাম ধর্মের মতো অন্যান্য ধর্মও আত্মহত্যাকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করেছে।

আত্মহত্যা কোনো সমস্যারই সমাধান নয়। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যের অভাব, বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তাকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলছে। জীবনের সব সমস্যাকে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে সমাধান করে ফেললেই মানুষ সফলতার শিখরে আরোহণ করতে পারে। সময় ও পরিস্থিতি আস্তে আস্তে বদলে যায়। জীবনে আঁধার সবসময় থাকে না, আঁধার কেটে গিয়ে একটা সময় আলো আসেই।

শিক্ষার্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়