সিরাজুম মনিরা: জীবন পূর্ণতা পাওয়ার আগেই যদি জীবনের শেষ পাতার গল্প লিখতে হয় নিজের হাতে, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? জন্ম থেকেই বিদায়ের সূচনা। মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। মৃত্যু নিঃসন্দেহে একটি হƒদয়বিদারক চিরসত্য অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু বর্তমান সমাজে ইচ্ছাকৃত মৃত্যু তথা ‘আত্মহত্যা’ নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা যেন সব সমাধানের উপায় হয়ে উঠেছে। বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গত বছর অন্তত ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সংস্থাটি বলছে, এক বছরে এত শিক্ষার্থী আগে কখনও আত্মহত্যা করেননি।
২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৯। অথচ এর আগে, ২০১৮ ও ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১১ ও ১৯ জন। ২০২২ সালের জুন মাস অবধি এ সংখ্যা নেহাতই কম নয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১ জুন চিরকুট লিখে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৬তলা ভবন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় জায়না হাবিব প্রাপ্তি! ৫ জুন ‘ও ধিহহধ নধপশ ধমধরহ ঢ়ৎড়ঢ়বৎষু’ স্টোরি দিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০ ব্যাচের কাজল মণ্ডল, ৬ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ২০১৮-২০১৯ সেশনের শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া দিশা এবং ১৩ মে গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম, মৃত্যুর আগে সে হতাশার কথা লিখে গেছে।
এছাড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবিদ বিন আজাদ ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এবিএম ত্বকী তানভীর, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) ইমাম হোসেন মিশু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অমিত কুমার বিশ্বাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহাগ খন্দকার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) পল্লবী মণ্ডল, ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির আকাশ রায় তারা সবাই এ বছরে সবকিছু থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বেছে নেয় আত্মহত্যাকে! আত্মহত্যার মিছিল যেন বেড়েই চলেছে দিন দিন। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, সম্পর্কের অবনতি ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ, পারিবারিক সমস্যা ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক যন্ত্রণা ১৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ, আর্থিক সমস্যা ৪.৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্তি ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশ কারণ আত্মহত্যার জন্য দায়ী!
মৃত্যু হচ্ছে আমাদের জীবনে নিয়ন্ত্রণবিহীন অতিথি, তবে সেটা যদি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে, তবে তা কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো নয়। বাবা-মা জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দিয়ে, সব ত্যাগ স্বীকার করে একটা সন্তানকে হাজারো আশা নিয়ে বড় করে তোলে, কিন্তু কিছু সমস্যা আর হতাশার ফলশ্রæতি যদি হয় প্রিয় সন্তানের আত্মহত্যা তাহলে সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ কঠিন সময়। দিন যত যাচ্ছে আমরা তত বেশি টেকনোলজিতে আসক্ত হয়ে পড়ছি, যার ফলে আমরা আমাদের আশপাশের মানুষ থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি, আমাদের সব সমস্যা, আবেগ, ভালোবাসা যেন ফেসবুকের ওই নীল দুনিয়াই সীমাবদ্ধ।
শরীরে অসুখ বাঁধলে মানুষ ডাক্তারের কাছে যায় কিন্তু মনের অসুখের খোঁজ রাখি কি? মনেরও যে অসুখ হতে পারে, এ যেন আমাদের সমাজের চিরাচরিত নিয়মের বাইরে। তাই তো বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা জানিয়েছেন, কিছু বদ্ধমূল সামাজিক ধারণার কারণে এখনও অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চায় না। ২০১৮-১৯ সালের মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ বা ২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং ১০০ জনের মধ্যে ৭ জন ভুগছেন বিষণœতায়। অবাক করা বিষয় হলো এর ৯২ শতাংশই রয়েছেন চিকিৎসার আওতার বাইরে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, কুল্লু নাফসিন যাইক্বাতুল মাউত। (প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)! মৃত্যু মানুষের জীবনে এক অপ্রিয় সত্য উপহার। কেউ কি ছেড়ে যেতে চাই এই সুন্দর ধরণী? তবে হ্যাঁ, বর্তমান তরুণ সমাজের মধ্যে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার নেশা, আর সেটা দিনের পর দিন বেড়েই চলছে! আমরা যদি এখনি এ বিষয়ে সচেতন না হয় তবে এর ভবিষ্যতে পরিণতি হবে আরও মারাত্মক। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শারীরিক অসুস্থতার মতো দৃশ্যমান না হলেও এর পরিণতি কিন্তু একই রকম বিপজ্জনক! তাই এখনি পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সিলর নিয়োগ করা এখন সময়ের দাবি। পাশাপাশি মানুষকে মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে জানাতে এবং তাদের ভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করার জন্য সচেতনতামূলক কর্মসূচি, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে এ সমস্যার পুরোপুরি সমাধান না হলেও অনেকাংশে সমাধান হবে বলে মনে করি। তাছাড়া হতাশাগ্রস্ত মানুষকে মানসিক সহায়তা দিতে হেল্পলাইন সেবা চালু করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘কান পেতে রই’। প্রতিষ্ঠানটি সংস্থাটি অনলাইন ও ফোন কলের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষকে সেবা দিচ্ছে। হতাশা থেকে মুক্তির উপায় কখনও আত্মহত্যা হতে পারে না, হতাশা থেকে মুক্তির উপায় হতে পারে আত্মউন্নয়ন। জীবন ফুলশয্যা নয় (খরভব রং হড়ঃ ধ নবফ ড়ভ ৎড়ংবং) জীবনে চলার পথে বিভিন্ন বাধা, সমস্যা, হতাশা আসবেই। কেননা এগুলো জীবনেরই একটি অংশ। কিন্তু জীবনের এসব কঠিন সময়ে ভেঙে না পড়ে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, রাত যত গভীর হয়, প্রভাত তত নিকটে আসে!
সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইম ‘সুইসাইড’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যারা সমাজের সঙ্গে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ত এবং যারা সমাজ থেকে অতিমাত্রায় বিচ্ছিন্ন, তারা উভয়েই আত্মহত্যা করে।’ তাই জীবনের সব ক্ষেত্রে ব্যালেন্স রাখা খুব বেশি জরুরি। একজন শিক্ষার্থী ও সচেতন নাগারিক হিসেবে প্রত্যাশা, মেধা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা নিয়ে অপার সম্ভবনায় ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাক সব শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ