আদানির জন্য ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বাড়বে ১৭৪%

ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে বিঘ্নিত হচ্ছে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ বা রেন্টাল ও আইপিপির বিলও দিতে পারছে না পিডিবি। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতে সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এজন্য বাধ্য হয়ে দেশি-বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছে পিডিবি। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব

ইসমাইল আলী: আদানির বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়েছে গত মাসে। ভারতের ঝাড়খন্ডের কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বর্তমানে চলছে। এতে ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। তবে আগামী জুলাই থেকে দ্বিতীয় ইউনিটও চালু হবে। তখন দৈনিক এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ। তবে এ বিদ্যুতের দাম পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ আমদানির দায় মেটাতে বিদেশি ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করেছে সংস্থাটি।

সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও তার বিলের বিস্তারিত চিত্র উঠে এসেছে। চিঠির তথ্যমতে, এতদিন ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে বছরে ব্যয় হতো ৬৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হবে বছরে ১১৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ আদানির জন্য ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় বাড়ছে প্রায় ১৭৪ শতাংশ।

এদিকে ডলার সংকটে বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো ডলার দিতে পারছে না। এর মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধে ডলার চাহিদা প্রায় তিনগুণ হয়ে যাবে। তাই ভারতের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে এক বছরের জন্য ১৮০ কোটি ডলার মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে চায় পিডিবি। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করেছে লোকসানি এ সংস্থাটি।

পিডিবির তথ্যমতে, এতদিন ভারত থেকে আমদানি করা হতো এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তবে আগামী জুলাই থেকে আদানির পুরো বিদ্যুৎ (এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট) আসা শুরু হবে। এতে আমদানি বেড়ে দাঁড়াবে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট। এতে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৫ কোটি তিন লাখ ডলার। আর বছরে লাগবে ১৮০ কোটি ২৯ লাখ ডলার। চিঠিতে বিদ্যুৎ আমদানির উৎস ও বিল বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

এতে দেখা যায়, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এনভিভিএন (এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম লিমিটেড) থেকে আমদানি করা হয় ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ আমদানি চুক্তির আওতায় মাসে গড়ে ছয় দশমিক ১১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হয়। এইচএসবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে এ বিল পরিশোধ করা হয়। এক্ষেত্রে বছরে ব্যয় হয় ৭৩ দশমিক ৩২ মিলিয়ন ডলার।

এনভিভিএনের আরও দুই কেন্দ্র থেকে আসে যথাক্রমে ৩০০ ও ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ দুই কেন্দ্রের জন্য মাসে গড়ে পরিশোধ করতে হয় ১৪ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার ও সাত দশমিক ৮৩ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এ দুই বিল পরিশোধ করা হয়। এ দুই কেন্দ্রের জন্য বছরে গুনতে হবে যথাক্রমে ১৭৩ দশমিক ০৮ মিলিয়ন ডলার ও ৯৩ দশমিক ৯৪ মিলিয়ন ডলার।

ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত উৎস ছাড়াও পিটিসি ইন্ডিয়া থেকে ২০০ ও সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে বাংলাদেশ। এ দুই কেন্দ্রের জন্য মাসে গড়ে পরিশোধ করতে হয় ১১ দশমিক ৩০ মিলিয়ন ডলার ও ১৩ দশমিক ৮১ মিলিয়ন ডলার। রূপালী ব্যাংকের মাধ্যমে এ দুই বিল পরিশোধ করা হয়। এতে বছরে গুনতে হয় যথাক্রমে ১৩৫ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন ডলার ও ১৬৫ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন ডলার।

এর বাইরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের জন্য দেশটির পাওয়ার গ্রিড করপোরেশনকে মাসে এক দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার দিতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এ বিল পরিশোধে বছরে ব্যয় হয় ১৭ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার। আর আদানির বিদ্যুতের জন্য মাসে ব্যয় হবে ৯৫ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন ডলার। ফলে বছরে বিল দিতে হবে ১১৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।

পিডিবির তথ্যমতে, আদানির ঝাড়খন্ডের কেন্দ্রে সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ (প্লান্ট ফ্যাক্টরে) বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ রয়েছে। তবে পিডিবি বর্তমানে আদানির কেন্দ্রের সক্ষমতার ৬৫ শতাংশ (প্লান্ট ফ্যাক্টর) বিদ্যুৎ কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪ হাজার ৬০০ কিলোক্যালরির কয়লা ব্যবহার করবে আদানি। এজন্য প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ধরা হয়েছে ১৬২ ডলার।

যদিও আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দাম নিয়ে গত জানুয়ারিতে বিতর্ক দেখা দেয়। কোম্পানিটি কয়লার দাম বেশি ধরলে তাতে আপত্তি জানায় পিডিবি। তবে সর্বশেষ আদানি বাজারদরে কয়লার দাম নির্ধারণের প্রস্তাব দেয়, যা পায়রা ও রামপালের কাছাকাছি হবে।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় ডলার সংকট থাকায় বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। এতে একদিকে পিডিবির ওপর সারচার্জ আরোপ হচ্ছে, অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তাই ভারতের বিদ্যুৎ আমদানির বিল মেটাতে বৈদেশিক ব্যাংকের মাধ্যমে মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি ১৮০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়।

জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকট নিয়ে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে পিডিবি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোয় বিদ্যুৎ বিল জমা দিলেও তারা ডলার সংকটের কারণে তা পরিশোধ করতে পারছে না। তাই ঋণ গ্রহণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এতে একদিকে সরকারের নগদ ডলার সরবরাহের ওপর চাপও কমবে, অন্যদিকে পিডিবিও বিল পরিশোধে কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছের ওপর। তারা ইতিবাচক মতামত দিলে ঋণ খোঁজা শুরু হবে।