চুক্তির দায় বাংলাদেশের কাঁধে

আদানির বিদ্যুৎ কমপক্ষে ৩৪% না কিনলে গুনতে হবে জরিমানা!

ইসমাইল আলী:আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর চুক্তি করে বাংলাদেশ। আগামী মাসে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর কথা রয়েছে। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এ কেন্দ্র থেকে বছরে কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতেই হবে। না হলে জরিমানা গুনতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি ক্যাপাসিটি চার্জ তো রয়েছেই। যদিও দেশীয় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য এ ধরনের গ্যরান্টি বা জরিমানার বিধান নেই।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সঙ্গে আদানি পাওয়ার লিমিটেডের স্বাক্ষরিত ১৬৩ পৃষ্ঠার গোপন চুক্তি (পিপিএ) বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। চুক্তিটি সরকারিভাবে গোপন করে রাখা হলেও সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তা অনলাইনে প্রকাশ করে দেয়।

চুক্তির ৩.১-এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে, পিডিবিকে চুক্তির প্রত্যেক বছর কেন্দ্রটির বিদ্যমান সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যা ‘মিনিমাম অফটেক কমিটমেন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যদি বাংলাদেশ তা কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের মধ্যে থাকবে আদানির কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয়, বন্দরে কয়লা খালাস ব্যয়, যা আদানি কয়লা সরবরাহ চুক্তি, কয়লা পরিবহন চুক্তি ও কয়লা হ্যান্ডলিং চুক্তির আওতায় বহন করবে।

শর্তটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যদি বাংলাদেশ আদানির সক্ষমতার ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনে তাহলে ২০ শতাংশের দাম পরিশোধ করবে। তবে সক্ষমতার ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ না কেনার ফলে অবশিষ্ট অংশের (৩৪% – ২০% = ১৪%) কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয়, বন্দরে কয়লা খালাস ব্যয় পরিশোধ করতে হবে। দেশীয় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের এ ধরনের গ্যারান্টি বা জরিমানার বিধান নেই। এছাড়া সক্ষমতার পুরোটার (৮৫% প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর) জন্য ক্যাপাসিটি চার্জও পরিশোধ করতে হবে।

যদিও জরিমানার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অবিচার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আদানি নিজস্ব খনির কয়লা ব্যবহার করবে, নিজস্ব জাহাজে করে তা নিজেদের বন্দরে খালাস করবে। আবার নিজস্ব ট্রেনে তা বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তাই চাহিদা না থাকলে বাংলাদেশ যদি বিদ্যুৎ নাও কেনে তাতে আদানির কোনো লোকসান হবে না। তাহলে কেন ক্ষতিপূরণের শর্ত দেয়া হয়েছে?

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহƒত হবে, তা আসবে আদানির মালিকানাধীন ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার বিতর্কিত খনি থেকে এবং আদানির জাহাজে করে। কয়লা খালাস হবে আদানির মালিকানাধীন বন্দরে। এসব কয়লা পরিবহন করা হবে আদানির মালিকানাধীন ট্রেনে করে। আবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিবহন করা হবে আদানিরই নির্মিত সঞ্চালন লাইনে। অথচ জ্বালানি খরচসহ এ পুরো প্রক্রিয়ার ব্যয় বইতে হবে বাংলাদেশকে, যা বৈশ্বিক বিদ্যুৎ খাতের অভিজ্ঞতায় অভূতপূর্ব। ফলে এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের জন্য দেশের অন্য যেকোনো সরবরাহকারী থেকে পাওয়া বিদ্যুতের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি হারে মূল্য দিতে হবে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই চুক্তিটি পূনর্মূল্যায়ন করা উচিত। প্রয়োজনে তা বাতিল করতে পারে বাংলাদেশ।

যদিও চুক্তি আপাতত বাতিলের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বাংলাদেশ। বরং কয়লার দাম বাড়তি ধরায় চুক্তিটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হবে। গত সপ্তাহে আদানির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ে তারা সম্মত হয়েছে।

সূত্রমতে, উš§ুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বরে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনা হয়। এতে দাম পড়ে প্রতি মেট্রিক টন ২৩৭ ডলার। আর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা কেনার দর প্রস্তাব জমা পড়েছে চলতি মাসে। এতে প্রতি মেট্রিক টনের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ২৩২ ডলার। অথচ আদানি গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম প্রস্তাব করেছে ৪০০ ডলার। অর্থাৎ রামপালের প্রায় দ্বিগুণ দাম প্রস্তাব করেছে আদানি।

কয়লার দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিয়ে পিডিবি দেয়ায়, নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪০৪ ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে মানের কয়লা কেনা হচ্ছে, তাতে প্রতি মেট্রিক টনে ৪৫ শতাংশ ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। চুক্তিমতে, প্রতি টন কয়লার দাম ১১০ ডলারের বেশি হলে বাড়তি দামের ৫৫ শতাংশ পরিশোধ করতে হয় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রকে।

পায়রার এ চুক্তির শর্ত দেশের অন্যান্য কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হয়নি। এতে আদানির কয়লার জন্য পুরো দামই পরিশোধ করতে হবে। ফলে চার হাজার ৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লায় মাসে গচ্চা যাবে প্রায় ৬৪ মিলিয়ন ডলার বা ৬৮৪ কোটি টাকা (এক ডলার = ১০৬.৯৫ টাকা)। তাই পিপিএ সংশোধন না করলে আদানিকে বিদ্যুতের চাহিদা দেয়া হবে না। প্রয়োজনে বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে।

তবে পিডিবি না চাইলেও বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য বলে গত সপ্তাহে মিটিংয়ে আদানির পক্ষ থেকে জানানো হয়। এ সময় তারা ন্যূনতম ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কেনার শর্তের কথা পিডিবির সামনে তুলে ধরে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদানির প্রতিনিধিরা কয়লার দামে ডিসকাউন্ট ফ্যাক্টর বিবেচনায় সম্মত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উভয়পক্ষ কাজ করবে বলে প্রাথমিকভাবে আদানির প্রতিনিধিদল রাজিও হয়। এক্ষেত্রে পায়রা/রামপালের দামে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার দাম নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। তবে পিডিবি না চাইলেও ন্যূনতম বিদ্যুৎ কিনতেই হবে বলে তারা জানিয়ে দিয়ে যায়। তখন পিডিবি চুক্তির ধারাটি দেখে। এর আগে এ ধারা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।

এদিকে আদানির কেন্দ্রটি পুরো সক্ষমতায় উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকলে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ২৬ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা।

চুক্তির শর্তানুসারে, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাড়তি সুবিধা এখানেই শেষ নয়। এক্ষেত্রে যদি আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ দিতে প্রস্তুত থাকে, তবে পিডিবি কোনো কারণে চাহিদা দিয়েও সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ না কেনে, তবুও আদানি কয়লার পুরো মূল্যই পাবে। তবে কয়লার দাম দিলেও এর মালিকানা পিডিবি পাবে কি না, তা চুক্তিতে বলা হয়নি।

এদিকে গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা দেয় ২০১৯ সালে। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাবে আদানি। এতে কমবে ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয়। তাই কর-ছাড়ের বিষয়টি বাংলাদেশকে ৩০ দিনের মধ্যে জানানোর শর্ত থাকলেও জানানো হয়নি তিন বছরে। মূলত বাড়তি ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লার দাম নেয়ার জন্য প্রতারণা করেছে আদানি।