Print Date & Time : 11 September 2025 Thursday 10:49 am

আদিবাসী বিতর্ক: বাংলাদেশে স্মরণাতীত কাল থেকে কারা বসবাস করছে?

আ ন ম মাছুম বিল্লাহ ভূঞা :অভিবাসীর বিপরীত শব্দ আদিবাসী। আন্তর্জাতিক অভিবাসন হলো যখন মানুষ নিজ রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে এবং গন্তব্য দেশে ন্যূনতম সময়ের জন্য অবস্থান করে। অভিবাসন অনেক কারণেই ঘটে। অন্য দেশে অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানের জন্য অনেকে নিজের দেশে ছেড়ে চলে যায়। অভিবাসন করেছেন এমন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে অনেকে স্থানান্তরিত হয়। তাদের দেশে রাজনৈতিক অবস্থার কারণেও অভিবাসন হয়ে থাকে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, তাই আন্তর্জাতিক অভিবাসনের আরেকটি কারণ শিক্ষা। ব্রিটিশরা অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকায় অনেক কয়েদিকে নির্জন কারাবাস দিয়েছে ও দাস হিসেবে পাঠিয়েছে। অথবা বিভিন্ন কারণে কিছ– মানুষ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ থেকে অভিবাসী হয়েছে। আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের আদিবাসী বলা হয়, কারণ বাকি সবাই দাস হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে অথবা অন্য রাজনৈতিক আশ্রয় ও শিক্ষাগ্রহণ, জীবিকা নির্বাহের জন্য অভিবাসী হয়ে বহু মানুষ নাগরিকত্ব গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এজন্য ওইসব দেশে আদিবাসী রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে সে রকম কিছু হয়নি। আইএলও কনভেনশন প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী উপজাতি হলো একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচালিত তাদের উপজাতি বলা হয়।  

আবার আদি শব্দের অর্থ প্রথম, আর বাসী যার অর্থ বাসিন্দা; অর্থাৎ ‘আদিবাসী’ কথার অর্থ হল যারা প্রথম থেকেই বসবাস করে আসছে। আদিবাসীবিষয়ক সংজ্ঞাটি হলোÑআদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া ও উপনিবেশ সৃষ্টির শুরু থেকে বসবাস করছে; এবং যারা তাদের কিছু বা সব নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে রাখে। অবশ্য জাতিসংঘ নিজে আদিবাসীদের কোনো সংজ্ঞা দেয়নি। তবে, আদিবাসী শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ ওহফরমবহড়ঁং ঢ়বড়ঢ়ষব. প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ মর্গানের সংজ্ঞানুযায়ী আদিবাসী হচ্ছে, ‘কোনো স্থানে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাসকারী আদিমতম জনগোষ্ঠী যাদের উৎপত্তি, ছড়িয়ে পড়া এবং বসতি স্থাপন সম্পর্কে বিশেষ কোনো ইতিহাস জানা নেই।’

আভিধানিক সংজ্ঞানুসারে কোনো দেশ বা স্থানের আদিম অধিবাসী বা অতিপ্রাচীনকাল থেকে বসবাসরত জনগোষ্ঠীই ওই অঞ্চলের আদিবাসী। এখন বিবেচনা করা যাক, বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের বর্তমান ভূখণ্ড অধিকৃত হওয়ার পূর্ব থেকে বা প্রি-কলোনিয়াল কি না। তবে এ আলোচনার আগে একটি বিষয় নির্ধারণ করা জরুরি যে, বিবেচনাটি কি সম্পূর্ণ বাংলাদেশ ভূখন্ডের ওপর হবে, নাকি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক হবে? কারণ অঞ্চলভিত্তিক হলে ভিন্ন উত্তর সঞ্চার হয়, যেমনÑভাওয়াল রাজার পরগনা খ্যাত গাজীপুরে অন্তত তিন ধরনের মানুষ বসবাস করে। প্রথমতÑ শত শত বছর আগে থেকে যেসব মানুষ বসবাস করছে। দ্বিতীয়তÑযারা চাকরি বা ব্যবসা করতে গিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করে বা কিনে বসবাস করছে। তৃতীয়তÑযারা ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করছে, এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পোশাক শ্রমিক। কারণ ভাওয়াল রাজার পরগনা এখন শিল্প নগরী হিসেবে পরিচিত বটে। গাজীপুরে প্রথম দিকে বসবাস করা মানুষ আদিবাসী, যাদের মধ্যে প্রায় শতভাগ বাঙালি (হিন্দু বা মুসলিম)। তাহলে বাকি অন্য মানুষেরা অভিবাসী বা সেটেলার বলা যাবে না কেন? তেমনি সমতট অঞ্চলে যারা আদি বা শত শত বছর থেকে বসবাস করছে, তারা সমতটের আদিবাসী নয় কি? তাদেরও বেশির ভাগ মানুষ বাঙালি (হিন্দু, মুসলিম) বটে। 

একইভাবে আবার, ঢাকা শহরে এখন প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করলেও আদিকালে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করত না। তাহলে যারা আদিকাল থেকে ঢাকা শহরের বসবাস করছে, তারা ঢাকার আদিবাসী নয় কি? এবং বাকি যেসব মানুষ ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অন্য স্থান থেকে এসে বর্তমানে ঢাকা শহরে চাকরি, ব্যবসা ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এবং ঢাকায় নানাভাবে সেটেল হয়েছে, তারা সেটেলার বা অভিবাসী। তেমনিভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যারা প্রথম বসতি স্থাপন করেছেন তারাও সেখানের আদিবাসী। অঞ্চলভিত্তিক হলে এভাবে বলতে হবে যে, সমতটের আদিবাসী, গাজীপুরের আদিবাসী, ঢাকার আদিবাসী প্রভৃতি। 

সমগ্র বাংলাদেশকে ভূখণ্ড ধরা হলে বাংলাদেশের প্রথম উপনিবেশকারী হচ্ছে আর্যজাতি। তখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে চাকমা, মারামা, গারো, হাজং, সাঁওতাল কারও-ই অস্তিত্ব ছিল না। যদিও এখন আর্যজাতির অস্তিত্ব নেই। এজন্যই বাংলাদেশের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে ‘আদিবাসী’ বা আদি-বাসিন্দাদের উত্তরসূরি হওয়ার প্রথম দাবিদার এদেশের কৃষক সম্প্রদায়। যারা বংশপরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে। তাই বাংলাদেশের ‘আদিবাসী’ প্রকৃত দাবিদার বাংলার কৃষক, তারা হিন্দু-মুসলমান যে ধর্মের অনুসারী-ই হোক না কেন? আদিবাসীর আভিধানিক সংজ্ঞানুসারেÑসেই অর্থে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাসরত বাঙালিরা-ই আদিবাসী। বর্তমানে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে বিভিন্ন সময়ে আগত অন্যান্য নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের অধিবাসী বটে, আদিবাসী নয়।

যদিও উপজাতীয় সংস্কৃতি প্রধানত ধর্ম থেকে উৎসারিত। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা বাদে অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী গড়ে ৯০ ভাগ খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। মারমা ও ত্রিপুরাদের মধ্যেও প্রায় ৫০ ভাগ খ্রিষ্টান হয়েছে। চাকমাদের ক্ষেত্রে এ হার কিছুটা কম। কিন্তু চাকমাদের আদি ধর্ম বৌদ্ধ নয়। মোগল আমলের আগে তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। এভাবে ধর্ম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উপজাতি জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচার, রীতিতে পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা, অর্থনীতি ও প্রযুক্তির প্রভাবেও পাল্টে গেছে জীবনযাপনও। কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া নাগরিক ও সচ্ছল উপজাতিদের নিজস্ব পোশাকের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না। যদি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাহলে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে। এমনকি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি তারা মনে করে যে, তারা এই রাষ্ট্রে থাকবে না বা ভারতেও যোগ দেবে না, তবে তারা স্বাধীন রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে। বাংলাদেশে থাকলেও তারা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভূমির মালিকানা বাংলাদেশের হবে না এবং সে অঞ্চলে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। কাজেই জাতিসংঘ ও আইএলও-এর সংজ্ঞার অপব্যাখ্যা বাংলাদেশের উপজাতি জনগোষ্ঠীদের আদিবাসী বানানোর কোনো সুযোগ নেই। বরং ওইসব কনভেনশন ও চার্টার অনুযায়ী ট্রাইবাল বা উপজাতির যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা বিচার করেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো উপজাতি। একই কারণে আদিবাসী বিষয়ক জাতিসংঘ চার্টার বাংলাদেশের উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। 

তবে, আদিবাসী বিষয়ে আভিধানিক ও নৃতাত্ত্বিক সংজ্ঞার বাইরে জাতিসংঘের তরফ থেকে তিনটি চার্টারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এগুলো হলো: ১৯৫৭ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ৪০তম অধিবেশনে প্রদত্ত ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭ (নং ১০৭), আইএলও’র ১৯৮৯ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত ৭৬তম অধিবেশনে প্রদত্ত ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৮৯ (নং ১৬৯) এবং ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৮৯ (নং ১৬৯)- এর আর্টিকল ১ এর (ধ)-তে ট্রাইবাল বা উপজাতির সংজ্ঞা বলা হয়েছেÑ একটি দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্নতর যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও আইন দ্বারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিচলিত তাদের উপজাতি বলা হয়। এখন আইএলও’র এই সংজ্ঞাটি যদি আমরা বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও অন্যান্য সাবস্পেসিসগুলোর সঙ্গে বিচার করি তাহলে পরিষ্কার বোঝা যায়, তারা উপজাতি। কেননা, ট্রাইব শব্দের বাংলা অর্থ উপজাতি। ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৮৯ (নং ১৬৯)-এর আর্টিকল ১-এর (বি)-তে ইনডিজিন্যাস পিপল বা আদিবাসীর সংজ্ঞা বলা হয়েছে, আদিবাসী তারা যারা একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস করছে বা অধিকৃত হওয়া বা বর্তমান সীমানা নির্ধারণের আগে বা উপনিবেশ সৃষ্টির আগ থেকে বসবাস করছে। যারা তাদের কিছু বা সব নিজস্ব সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনগত অধিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে রাখে। অর্থাৎ আইএলও কর্তৃক উপজাতি ও আদিবাসী সংজ্ঞার মূল পার্থক্য হচ্ছে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বংশানুক্রমে বসবাস বা অধিকৃত হওয়ার, বর্তমান সীমানা নির্ধারণের আগে বা উপনিবেশ সৃষ্টির আগে থেকে বসবাস। বাকি শর্তগুলো মোটামুটি উপজাতিদের মতোই। অর্থাৎ একজন উপজাতি আদিবাসী হবেন বা হবেন না তা নির্ভর করবে উপরোক্ত শর্তের ওপর। এছাড়া ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৬১তম অধিবেশনে দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অব ইন্ডিজেনাস পিপলস চার্টার শুধু আদিবাসীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, উপজাতিদের নয়।

কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্যি যে, জাতিসংঘ নিজে আদিবাসীদের কোনো সংজ্ঞা না দিলেও, ২০১৭ সালে যেকোনো সংখ্যালঘু ব্যক্তিকেই তার ইচ্ছামতো নিজেকে আদিবাসী বা উপজাতি ঘোষণা করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে এবং জাতিসংঘ আদিবাসীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামে আদিবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র-২০০৭ এ আদিবাসীর বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধাদির কথা বিবৃত হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, ‘আদিবাসী’ শব্দটি রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের ভেতর কমপক্ষে ৪৫টি স্বায়ত্তশাসিত বা স্বশাসিত সরকার ব্যবস্থার সৃষ্টি হবে। এসব অঞ্চলে সরকার পরিচালনায় তারা নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয়তা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, আইন প্রণয়ন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে। এসব অঞ্চলের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ও কর্তৃত্ব ক্ষুণœ হবে। ওই ঘোষণাপত্রে আদিবাসীদের ভূমির ওপর যে অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা আরও ভয়ানক।

বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী আদিবাসী স্বীকৃতি পেলে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নিজস্ব আইনে নিজস্ব ভূমি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মুষ্টিমেয় চিহ্নিত উপজাতিরা দাবি করছে ঐতিহ্য ও প্রথাগত অধিকার বলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভূমির মালিক তারা। একই অধিকার বলে সমতলের উপজাতীয় অধ্যুষিত এলাকার সব ভূমির মালিকানা সেখানকার উপজাতিরা দাবি করবে। সেখানে যেসব ভূমি সরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় রয়েছে তা ফেরত দিতে হবে বা তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি উপজাতিরা রাজি না হলে সমতল থেকে সমপরিমাণ সমগুরুত্বের ভূমি ফেরত দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যেহেতু ওই গোষ্ঠী সব সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার দাবি জানাচ্ছে, সে কারণে সেখান থেকে সব সামরিক স্থাপনা সরিয়ে নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম ও অন্যান্য উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাঙালি বসতি স্থাপন করেছে তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। ঘোষণাপত্রের ৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদটি আরও ভয়ানক। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑআদিবাসী জনগোষ্ঠীর, বিশেষত্ব যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে, তারা অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠী তথা অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংক্রান্ত কার্যক্রমসহ যোগাযোগ, সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে। যদিও বাংলাদেশে বসবাসকারী সব উপজাতি জনগোষ্ঠীর মূল আবাস কম্বোডিয়া, ভারত ও মিয়ানমার। সেখানে এখনও তাদের মূল জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশে তাদের খণ্ডিত অংশ যদি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তাহলে বিপুল এলাকা আদিবাসী ল্যান্ড স্বীকৃতি পাওয়ার পথ উš§ুক্ত হবে। একই সঙ্গে সীমান্তের উভয় পাড়ের অভিন্ন জনগোষ্ঠী যদি অভিন্ন রাজনৈতিক, সরকার কাঠামো কিংবা স্বাধীনতার দাবি তুলে তা আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নেবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উল্লিখিত অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বিশেষভাবে ভূমিকা রাখতে পারবে, যা ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। পূর্ব-তিমুর, দক্ষিণ-সুদান স্বাধীনকরণে জাতিসংঘের ভূমিকা বিশ্বের দেশপ্রেমিক জনগণকে আতঙ্কিত করেছে। অধুনা পশ্চিম পাপুয়া নিউগিনিতেও জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

তাই ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করতে সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার না করা হয়, কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন ছোট ছোট সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীকে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতি চার হাজার বছরের পুরোনো। প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা সেটিই প্রমাণ করে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবারত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ১৬ শতকে ভারত, মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়া থেকে আসা শুরু করে। উপরন্তু বাংলাদেশের এই উপজাতীয় জনগোষ্ঠী তাদের আদিনিবাস ভারত ও মিয়ানমারের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত নয় এবং তারা নিজ নিজ ধর্ম পরিবর্তন করে এখন খ্রিষ্টধর্ম পালন করছে। তাছাড়া সব ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রতœতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর কেউই বাংলাদেশে স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করছে না। সেজন্য তারা সেখানকার আদিবাসী নয়। আরেকটি যুক্তি হচ্ছে, আদিবাসী হতে হলে কলোনিয়াল কিংবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কলোনাইজেশন হতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে সে ধরনের কিছুই হয়নি। 

জাতিসংঘের ৬১তম অধিবেশনে উপস্থাপিত আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্রটি ১৪৩টি দেশ পক্ষে, ৪টি দেশ বিপক্ষে, ১১টি দেশ ভোট দানে বিরত এবং ৩৪টি দেশ অনুপস্থিত থাকে। ভোট দানে বিরত থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিরুদ্ধে ভোট দেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং সার্বিক বিবেচনায় রাষ্ট্রের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছে বলেই পৃথিবীর অনেক দেশই আইএলও কনভেনশন-১৬৯ অনুমোদন করেনি।

বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত সবাই আইনের চোখে সমান। তাই আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে স্বাক্ষর করে অথবা সাংবিধানিকভাবে বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্যদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করলে ন্যায়সঙ্গত দূরে থাকুক, আইনসঙ্গতও হবে না। কারণ সব কিছু আইনসঙ্গত হলেই ন্যায়সঙ্গত হয় না। তাই অনেকেই মনে করেন দেশের কোনো একটি অংশকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। তখন রাষ্ট্রের মধ্যে চরম মতদ্বৈধতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য দেখা দেবে। তাছাড়াও সরকারের সঙ্গে ১৯৯৭ সালে পার্বত্যবাসী মানুষ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি’ সম্পন্ন করেন। ওই চুক্তির সর্বত্র ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ রয়েছে, কোথাও ‘আদিবাসী’ নেই। এমনকি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আইন, বিধি ও যাবতীয় সরকারি দলিলপত্রে ‘ট্রাইবাল’ বা ‘উপজাতি’ রয়েছে, ‘আদিবাসী’ নামক শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই। এমনকি, যুগে যুগে উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা প্রভৃতি নামে অভিহিত হলেও, ইতিহাসের কোনো সময়েই, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই এদের কখনোই ‘আদিবাসী’ (ওহফরমবহড়ঁং) বলা হয়নি।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা ২০০০ সালে নিজেদের আদিবাসী দাবি করে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালন শুরু করে। পরে তারা দেশের সমতলের বিভিন্ন উপজাতীয় ও তফসিলি জনগোষ্ঠীকেও এতে শামিল করে মোট ৪৫টি মতান্তরে ৭৫টি জনগোষ্ঠীকে একত্রে আদিবাসী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্বীকৃতি দাবি করে। কিন্তু বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর এই আদিবাসী দাবি শুরুতেই দেশের মধ্যে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করে। কারণ, আভিধানিক ও নৃ-তাত্ত্বিক সংজ্ঞা অনুযায়ী আদিবাসী মানে আদিবাসিন্দা। নৃ-গোষ্ঠী হলেই আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় কারণ নেই। কেননা বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বাঙালিরাও ছিল এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীও এ অঞ্চলে কালক্রমে ও পর্যায়ক্রমে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদরা স্পষ্টত মনে করেন, বাংলাদেশে একশ্রেণির হাতেগোনা কিছু ব্যক্তি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে ‘আদিবাসী’ শব্দটি জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে বিতর্ক উসকে দিয়ে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি ও রাষ্ট্রবিরোধী হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। যদিও বাংলাদেশের প্রি-কলোনিয়াল জনগোষ্ঠী হচ্ছে নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উঠে আসে মূলত বাঙালি জনগোষ্ঠী। কিন্তু রাষ্ট্র আদিবাসী শব্দ চয়ন বাদ দিয়ে সব নাগরিককে সমান মর্যাদা দিয়েছে, যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ-২৭-এ বলা আছে। এই অনুচ্ছেদকে গুরুত্ব না দিলে রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হতো। তবে বাংলাদেশ সরকার দেশের নাগরিক হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগণ যাতে তাদের অধিকার পায় সেটি নিশ্চিত করছে এবং শিক্ষাগ্রহণ এবং সরকারি চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের বাড়তি সুবিধাও দিচ্ছে।

তারপরও কিছু জ্ঞানপাপী লোক সংবিধানকে অবজ্ঞা করে দাবি করছেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এবং তাদের ভাষ্য এই স্বীকৃতি দিলে রাষ্ট্রের মানবিকতা উন্নত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক আছেন, কিন্তু তারা সবাই যদি অধ্যাপক হিসেবে দাবি করে, তাহলে রাষ্ট্র তাদের অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে কি? অথবা, পুলিশ বিভাগে অনেক ব্যক্তি চাকরি করেন, তারা যদি সবাই আইজিপি বলে দাবি করে, রাষ্ট্র তাদের ওই স্বীকৃতি দেবে কি বা স্বীকৃতি দেয়া যৌক্তিক হবে কি? যে কেউ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে অনেক কিছু দাবি করতে পারে, যদি না তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি না করে। যদিও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি না থাকলেও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেই যেমনÑঅধ্যাপক বা পুলিশে চাকরি করলে যেমনÑ আইজিপি দাবি করা যাবে না। তাই অধিবাসী হলেই রাষ্ট্রের কাছে আদিবাসী বলে দাবি করা সমীচীন হবে না।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com