আদি জ্ঞান, যা ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান বা স্থানীয় জ্ঞান নামেও পরিচিত, হল জ্ঞান, অনুশীলন এবং বিশ্বাসের একটি সমষ্টি; যা আদিমানব জাতি প্রজšে§র পর প্রজন্ম ধরে তাদের পরিবেশ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে বিকশিত করে। এটি বস্তুতন্ত্র, আধ্যাত্মিকতা এবং সামাজিক ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে, যা প্রায়ই মৌখিকভাবে বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুশীলনের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। এই জ্ঞান স্থির নয়, এটি পরিবর্তনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।
আদি মানব জাতির জ্ঞান হলো এমন একটি সমষ্টিগত শব্দ, যা বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে অসংখ্য নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে সঞ্চিত বহু স্থানভিত্তিক জ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে। পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় আদিবাসীদের দ্বারা সহস াব্দ ধরে এবং অব্যাহত প্রয়োগ সত্ত্বেও, অ-আদিবাসী “পশ্চিমা” বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং ব্যবস্থাপনা সম্প্রতি আদি জ্ঞানকে বিবেচনা করেছে। আমরা বিস্তারিত এবং বৈচিত্র্যময় উদাহরণ ব্যবহার করে তুলে ধরি যে, কীভাবে ক্রমবর্ধমানভাবে গবেষণা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, বাস্তুবিদ্যা এবং বিবর্তন, সেই সাথে শারীরবিদ্যা এবং প্রয়োগিত বাস্তুবিদ্যা (অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা) সম্পর্কে ধারণা বৃদ্ধি করে এবং নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই জ্ঞানের এর বিভিন্ন অবদান প্রজাতি, বাস্তুতন্ত্র এবং বস্তুতন্ত্র প্রক্রিয়াগুলোর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ, মিথস্ক্রিয়া এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে উদ্ভূত। আদি জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের মধ্যে মিল থাকা সত্ত্বেও, আমরা আদি জ্ঞানের ধারকদের সাথে কাজ করার সময় বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয়তা নৈতিক কর্তব্যের রূপরেখা তৈরি করি। অতীত এবং বর্তমানের ন্যায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, আদি মানবজাতি আত্মনিয়ন্ত্রণকে সম্মান করা পারস্পরিক উপকারী গবেষণা প্রক্রিয়া এবং ফলাফলকে সমর্থন করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রয়োজন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আনুষ্ঠানিকভাবে রূপ নেয়ার অনেক আগে থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে তথ্য তৈরি, প্রেরণ এবং প্রয়োগ করে আসছিল। হাজার বছর ধরে বিশ্বজুড়ে আদি মানব জাতির জৈব-ভৌত এবং পরিবেশগত প্রক্রিয়া, ভূ দৃশ্য, বস্তুতন্ত্র এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাথে সরাসরি মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জ্ঞান ব্যবস্থা তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিকশিত করেছে (অঃষবড় ২০১১; ইবৎশবং ২০১৮)। বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে এই বিস্তৃতি এবং গভীর জ্ঞানের প্রয়োগ বাস্তুবিদ্যা, বিবর্তন এবং সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সাহিত্যে অনেক অবদান রেখেছে, কিন্তু এখনও ব্যাপকভাবে সংশ্লেষিত হয়নি। আদি মানব জাতির জ্ঞান হলো স্থানভিত্তিক জ্ঞানের একটি সমষ্টি; যা পশ্চিমা বিজ্ঞানে ক্রম বর্ধমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক সাহিত্যের উদাহরণ ব্যবহার করে, আমরা দেখাই কীভাবে আদি মানব জাতির বস্তু বিদ্যার, বিবর্তন, শারীরবিদ্যা এবং প্রাযোগিক বাস্তুবিদ্যা বোঝার ক্ষেত্রে অসংখ্য অবদান রেখেছে। প্রেরণা এবং পদ্ধতির দিক থেকে আদি মানব জাতি প্রায়ই পশ্চিমা বিজ্ঞান থেকে আলাদা, তবে এমন কিছু ভাগ করা ধারণাগত ভিত্তি রয়েছে; যা উৎপাদনশীল এবং পারস্পরিকভাবে উপকারী সহযোগিতাকে সমর্থন করতে পারে। বিজ্ঞানীদের আদি মানব জাতির ধারকদের সঙ্গে একটি চিন্তাশীল সামাজিক চুক্তিতে প্রবেশ করা উচিত, সর্বপ্রথম অংশীদারিমূলক গবেষণার দিকে কাজ করা; যা আদিবাসী সম্প্রদায়, সরকার এবং অন্যান্য জাতিগুলোকে উপকৃত হবে। দীর্ঘমেয়াদি পর্যবেক্ষণ থেকেও শারীরবৃত্তীয় জ্ঞানের উদ্ভব হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, ওষধ, আশ্রয়, পোশাক এবং আরও অনেক কিছুর জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী সংগ্রহ এবং প্রস্তুত করা হয়। আদিবাসী বিজ্ঞান সাহিত্যে যেসব শারীরবৃত্তীয় ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তার মধ্যে রয়েছে রূপবিদ্যা (যেমন, ঊপশবৎঃ বঃ ধষ. ২০১৮), বিপাক (যেমন ওফৎড়নড় ধহফ ইবৎশবং ২০১২), এবং বন্যপ্রাণীর স্বাস্থ্য এবং শরীরের অবস্থা (যেমন ঈধঃষবু ২০০৬)। উদাহরণস্বরূপ, ঊপশবৎঃ বঃ ধষ. (২০১৮), পশ্চিম কানাডার ঐধণ্ডুধয়া, করঃধংড়ড়/ঢধর’ীধরং, ঘীঁধষশ বেং ডঁরশরহীাঁ জনগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক বিবরণের ওপর ভিত্তি করে হলুদ চোখের রকফিশের (ঝবনধংঃবং ৎঁনবৎৎরসঁং) আকারের পরিবর্তনের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আকার অনুমানের হাতের অঙ্গভঙ্গি পরিমাপ থেকে প্রাপ্ত এই বিবরণগুলো অর্ধশতাব্দীরও বেশি তথ্য সরবরাহ করেছে; যা রকফিশের আকারের ঐতিহাসিক ভিত্তি রেখা প্রসারিত করেছে, যা উর্বরতা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একটি মূল প্রতিরূপ। আদি জ্ঞান কীভাবে স্বাস্থ্য এবং শরীরের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে পারে তার একটি উদাহরণ পূর্ব আফ্রিকা থেকে এসেছে। কেনিয়ার এবং দক্ষিণ সুদানে, ক্যাটলি (২০০৬) আদিবাসী পশুপালক এবং পশুচিকিৎসকদের মধ্যে রোগ শনাক্তকরণ এবং রোগ নির্ণয়ের মানদণ্ডে তাদের স্বাধীন পদ্ধতিতে একমত খুঁজে পেরেছেন। পশুচিকিৎসকদের দ্বারা স্বীকৃত একটি বিন্যাসে আদিবাসী শব্দগুলোকে অনুবাদ করা এবং বিপরীতভাবে, গ্রামীণ এলাকায় ব্যবহারের জন্য সাংস্কৃতিকভাবে প্রাসঙ্গিক রোগ নির্ণয়ের মানদণ্ড প্রদান করে উন্নত পশুপালন নজরদারির ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলা জনপদে আদি জ্ঞানী নারী ছিলেন খনা। তিনি নানা বিষয়ে বচন দিয়েছেন, যা প্রকৃতি ও আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ হয়েছে। খনার বচন মূলত কৃষিতত্ত্বভিত্তিক ছড়া, আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। অনেকের মতে, খনা নামি জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী বাঙালি নারী। তার ছড়াগুলো নিয়ে মতভেদ আছে। অজস খনার বচন যুগ-যুগান্তর ধরে গ্রামবাংলার জনজীবনের সাথে মিশে আছে। জনশ্রুতি আছে, খনার নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসত সদর মহকুমার দেউলিয়া গ্রামে (বর্তমানে চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থল, যেটি খনা মিহিরের ঢিবি নামে পরিচিত)। খনা ছিলেন বৈদ্য বংশজাত। এমনকি তিনি রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের দশম সদস্য ছিলেন বলে কথিত। বরাহমিহির বা বর রুচি-এর পুত্র মিহির তার স্বামী ছিল বলেও কিংবদন্তি কথিত আছে। খনার রচনাগুলো পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যেমনÑ১ . কৃষিকাজের প্রথা ও কুসংস্কার বিলোপ, ২. কৃষিকাজ ফলিত, ৩. জ্যোতির্বিজ্ঞান, ৪. আবহাওয়া জ্ঞান এবং ৫. শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ। খনা কৃষি সম্পর্কে বলেছে, ‘শুনরে বাপু চাষার বেটা। মাটির মধ্যে বেলে যেটা। তাতে যদি বুনিস পটোল। তাতে তোর আশায় সফল ॥ তিনি আরও বলেছেন, আখ, আদা, পুঁইÑএই তিন চৈতে রুই॥ কৃষককে বলোগে বাঁধতে আল ॥ আজ না হয় হবে কাল ॥ বাঁশের ধারে হলুদ দিলে। খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে॥ গাই পালে মেয়ে, দুধ পড়ে বেয়ে ॥ ডাক ছেড়ে বলে রাবণ, কলা রোবে আষাঢ় শ্রাবণ ॥’ খনার বচনগুলোর সঙ্গে কৃষি উৎপাদন উতপ্রতভাবে জড়িত। যার প্রভাব এখনও বিদ্যমান অর্থ্যাৎ এই প্রথাগুলো মানলে এখনও উৎপাদন বাড়বে, যেমন নারী যদি গাভিকে লালনপালন করে সেই গাভি অধিক দুধ দেয় এটা বাস্তব। কৃষিকাজ ফলিত সম্পর্কে খনা বলে গেছেন, ‘বিশ হাত করি ফাঁক। আম-কাঁঠাল পুঁতে রাখ। গাছগাছি ঘন রোবে না। ফল তাতে ফলবে না। জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে খনা বলে গেছে, আষাঢ়ে উৎপত্তি, পত্রাবনে, যুবতী, ভাদে, পোয়াতী। আশ্বিনে বুড়া, কার্তিকে দেয় উড়া ॥ আঁধারে পড়ে চাঁদের কলা, কতক কালা, কতক ধলা, উত্তর উঁচু, দক্ষিণ কাত, ধারায় ধারায় ধানের ধাত ধান-চাল দুই-ই সমান মিষ্টি হবে লোকের কথা ॥ যে গুটিকাপাত হয়, সাগরের তীরেতে, সর্বদা মঙ্গল হয়, কহে জ্যোতিষেতে, নানা শস্যে পরিপূর্ণ, বসুন্ধরা হয়, খনা কহে মিহিরকে, নাহিক সংশয়? তার আবহাওয়া সম্পর্কিত পূর্ব সতর্কমূলক বার্তাগুলো এখনও ফলছে, তিনি আবহাওয়া সম্পর্কে বলেছেন, পূর্ব আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়, সেই বৎসর বন্যা হয় ॥ পাঁচ রবি মাসে পায়, ঝরা কিংবা খরায় যায় ॥ জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে, তবে জানবে বর্ষা বটে ॥ আসমান ফাঁড়া ফাঁড়া। বাতাস বহে চৌধারা ॥ পশ্চিমের ধনু নিত্র খরা। পূর্বের ধনু বর্ষে ঝরা? চৈতের কুযা আমের ক্ষয়, তাল তেঁতুলের কিবা হয়? অর্থ-কুয়াশায় আমের বোল নষ্ট হয়ে যায়। আমের মুকুল নিয়ে কথাটি খনা কয়েক শত বছর আগে বলে গেছেন, এখনও তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। শস্যের যত্ন সম্পর্কে খনা বলে গেছেন, খনা বলে শুনে যাও। নারিকেল মূলে চিটা দাও। গাছ হয় তাজা মোটা। তাড়াতাড়ি ধরে গোটা ॥ খনার বচনগুলো বাংলা জনপদের পরিবেশ প্রকৃতির সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। খনার একটি কথা এখনও ধ্রুব সত্য বলে বাংলার জনপদের মানুষ বিশ্বাস করেন। তিনি বলেছেন যে দিনে জল রাতে তারা এই দেখবে শুকনো ধরা। এই কথাটির প্রমাণ পওয়া যায় এখনও। খনার বচন থেকে জ্যোতির বিদ্যার একটি বিষয় পাওয়া যায় তা হলো, আষাঢ়ে মাসের প্রথম চাঁদের শুক্লাপক্ষের নবমীর দিন অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ৯ তারিখে যদি মুষল ধারে বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা কম হবে। যদি সামান্য ছিটেফোটা বৃষ্টি হয় তাহলে বর্ষা বেশি হবে। সেদিন মাঝারি বৃষ্টিপাত হলে ফসলের উৎপাদন ভালো হবে আর যদি আদৌ বৃষ্টি না হয় তাহলে সে বছর ভালো ফসল হবে না।
খনা কোনো একক মহীয়সী নারী অথবা সকলের সম্মিলিত প্রয়াস বা সকলের অভিজ্ঞতার সম্মিলিত রূপেই কালে কালে প্রকাশ পেয়েছে। হতে পারে যে কোনো কিছুই কিন্তু খনার বচন নিঃসন্দেহে সেই অতীত কাল থেকেই আমাদের কৃষি ও প্রকৃতিনির্ভর জীবনব্যবস্থাকে করেছে উন্নত থেকে উন্নত তর। দিয়েছে আমাদের ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতির একটি ধারা; যা আমাদের চিন্তা-চেতনাকে আজও প্রভাবিত করে। খনার বচনের মাধ্যমে আমরা জানতে শিখি আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে আমাদের অতীতের গর্বভরা ইতিহাসকে। তাই এর সমস্ত দিকগুলোকে কুসংস্কার আখ্যা দেয়া যাবে না। আদি জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চাকে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে যদি গবেষণা করা যায় তাহলে একটা মঙ্গলজনক ফল পাওয়া যাবে। ইন্ডিজিনিউয়াস নলেজ বাদ দিয়ে নতুন বিজ্ঞানচর্চাটা যথোপযুক্ত হবে না।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী, মুক্ত লেখক
কাদিরগঞ্জ দরিখোরবোনা, রাজশাহী