আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদন ও নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ

 

স্থপতি হাসান শাহরিয়ার খান (নিলয়): বয়সের দিক থেকে আমার বয়স যে অনেক বেশি তা নয়। তারপরও বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে এই ৪২ বছর বয়সেও কেন জানি মনে হচ্ছে একটা বিরাট ‘জেনারেশন’ গ্যাপ তৈরি হয়ে গেছে।

৮০-৯০ দশকে বাংলাদেশে যারা শৈশব পার করেছে তাদের কাছে প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদন অনেকটাই দুষ্প্রাপ্য ছিল। ৯০ দশকের শিশু-কিশোরদের কাছে বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন থাকাই ছিল বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। এমনকি সবার বাসায় টেলিভিশন ছিলও না। এ প্রজন্মের অনেকেই জানলে অবাক হবে, সেই জমানায় টিভির জন্য সরকার লাইসেন্স দিত এবং বছর বছর সেই লাইসেন্স নবায়ন করতে হতো। এখনকার মতো টেলিভিশন চ্যানেলের পর চ্যানেলে বদলের সুযোগও ছিল না। আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল সরকারি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। তবে ঢাকার বাইরে অনেক জায়গায় ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল দেখা যেত। ভারতীয় চ্যানেল  দূরদর্শন, ডিডি ১, ডিডি ৭ চ্যানেলের মাধ্যমে আকাশ বিনোদনের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। তবে এই জিনিস দেখাও যে স্বচ্ছন্দ ছিল তা নয়। ছাদের ওপর একটা এন্টেনা থাকত। সেই এন্টেনায় বাঁধা থাকত রান্নাঘরের অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনা। যারা একটু বেশি আগ্রহী, তারা এন্টেনার সঙ্গে লাগাত নেটওয়ার্ক বুস্টার। টিভি দেখার সময় শুরু হতো নানা কসরত! বাসার ভেতরে একজন টিভিতে তাকিয়ে থাকত, টিনের চাল বা ছাদের ওপর আরেকজন এন্টেনা ঘুরাতে ঘুরাতে চিৎকার করত ক্লিয়ার হইছে? নিচ থেকে আরেকজন আওয়াজ দিত, আর একটু ডানে ডানে … ব্যস, ব্যস, হইছে, হইছে…।

সবার বাসায় টিভি না থাকলেও বিনোদনের কোনো কমতি ছিল না। দল বেঁধে পুরা মহল্লা বা কলোনির শিশু-কিশোর যে বন্ধু বা আত্মীয়ের বাসায় টিভি ছিল সেখানে জড়ো হয়ে মজার মজার অনুষ্ঠান দেখা হতো। মনে পড়ে, বন্ধুবান্ধব ছোট বড় সবাই হাঁ করে জাদুর বাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আলিফ লায়লা, ম্যাকগাইভার বা সিন্দাবাদ!  আহা কী সময় ছিল! টিভি দেখতে যাওয়ার সময় আশপাশের বাসার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেক সময় অনেকের বাবা-মা বাসা থেকে বের হতে দিত না। ঘরে আটকে থাকা সেই বন্ধুদের শরীর ঘরের ভেতর বন্দি থাকলেও মন পড়ে থাকত আমাদের কাছে। বিটিভিতে হানিফ সংকেতের”ইত্যাদি”ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। চমৎকার সব কনটেন্ট উপস্থাপনের মাধ্যমে সপরিবারে উপভোগ করার মতো একটি দায়িত্বশীল অনুষ্ঠান এটি। বিনোদনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অসংগতি তুলে ধরে মানুষকে শুধু বিনোদনই দিত না, মানুষকে সচেতন ও অনুপ্রাণিতও করত। ৮০ বা ৯০ দশকের সামাজিক জীবন ব্যবস্থায় বিনোদন ছিল জীবনের এমন একটা অংশ, যা সবাই মিলে একসঙ্গে উপভোগ করার উপযোগী করে তৈরি করা হতো।

২০২৪ সালে সেই জাদুর বাক্স টিভি এখন কেবলই একটা সেকেলে যন্ত্র। এখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন। কিন্তু টেলিভিশন দেখার সময় কারও নেই। টিভির স্থান দখল করে নিচ্ছে মুঠোফোন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর খবর হাতের মুঠোয়, কিন্তু পাশে বসে থাকা মানুষের খোঁজ নেই। ফোনের স্ক্রিনে সবাই ব্যস্ত। মুখ তুলে আশপাশের জগৎ দেখার সময় করাই এখন কঠিন। স্ক্রিন আসক্তি এখন মাদকের আসক্তির পর্যায়ে চলে গিয়েছে। সুন্দর কিছু দেখলে বা সুন্দর একটা পরিবেশ এ বেড়াতে গেলে মানুষ এখন সৃষ্টিকর্তার দেয়া দুই নয়নে ১৮০ ডিগ্রি ফিল্ড অফ ভিউ বাদ দিয়ে, সেই সৌন্দর্য রেকর্ড করতে গিয়ে মোবাইল লেন্সের ভেতর দিয়ে তা মোবাইল স্ক্রিনে উপভোগ করে। সেই রেকর্ড করা ছবি, ভিডিও সে সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করে, সেই শেয়ারের মাধ্যমে কোনো দিন সামনাসামনি না দেখা হওয়া তার সামাজিক মাধ্যমের বন্ধুর বাহবা কুড়ায়। বিনোদন বা জীবনকে উপভোগ করার চাইতে নিজের জীবন প্রদর্শন করে অগুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে নিজেকে তুলে ধরাতেই এখন তারা বিনোদন খুঁজে নিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা বলে কিছু আর নেই।

তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে মাধ্যমে জীবনযাত্রায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। নতুন দিনের পরিবর্তিত বাস্তবতাকে স্বাগত জানাতেই হবে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখতে হবে, প্রযুক্তির ব্যবহারকারীদের মধ্যে সমাজের সর্বস্তরের সব রকমের মানুষই আছে। নতুন প্রযুক্তিকে খুব সহজে সবার হাতে হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। অথচ এ সম্পর্কিত সম্যক জ্ঞান ও শিষ্টাচার ততটা গুরুত্ব ও যত্নের সঙ্গে ব্যবহারকারীদের শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়নি। সরাসরি ব্যক্তিগতভাবে কারও ভুল শুধরে দেয়া বা কারও কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও প্রযুক্তিনির্ভর সামাজিক মাধ্যমের বিস্তৃত প্ল্যাটফর্মকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

সমাজের অধিকাংশ মানুষ এখন মোবাইল স্ক্রিনের সামাজিক মাধ্যমে আসক্ত। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। সবাই নিজের অবস্থান অন্যকে দেখাতে ব্যস্ত। মারাত্মক গভীর নার্সিসিজমের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে। সবাই হরদম কনটেন্ট দেখতে দেখতে ভার্চুয়াল জগতকে নিজের সমাজ ভেবে নিয়েছে। অনেক মানুষ এখন নিজের অবস্থানের বিচার করে অন্যর লোক দেখানো মিথ্যা অবস্থানের সঙ্গে মাপজোক করে।

শুধু তা-ই নয়, বিকৃত কর্মকাণ্ডও করছে অনেকে শুধু ‘ভাইরাল’ হওয়ার আশায়। মৃত আত্মীয়ের কবর খোঁড়ার সময় সেলফি তুলে বা মৃত ব্যক্তির লাশের ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করে অচেনা মানুষের সহানুভূতি কুড়াচ্ছে! আবার নিজেকে হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করে হলেও লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করছে। স্থূল ও নিম্নরুচির বিনোদন কনটেন্ট তৈরিকে ইতোমধ্যে অনেকেই উপার্জনের ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নতুন প্রজন্ম অন্ধের মতো তাদের অনুসরণ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সবাই যে নিম্নমানের কন্টেন্ট বানাচ্ছেন, তা নয়। অনেক সুস্থ বিনোদনধর্মী ও শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরি করছেন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই সহজে দ্রুত অর্থ উপার্জনের আশায় অনেকেই সস্তা বিনোদনে লিপ্ত হয়েছে। কিশোর-তরুণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখে ভাইরাল হওয়ার মাধ্যমে যাচ্ছেতাই করে নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথাকথিত সেলিব্রেটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এটা যে শুধু শহরে হচ্ছে তা না, সমগ্র দেশেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের ডাটা কনজামশন ভলিউম বৃদ্ধি হারের দিকে তাকালে বোঝা যায়, পরিস্থিতি কত দ্রুত পালটে যাচ্ছে।

৯০ দশকে পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠেছিল ভিডিও গেমসের দোকান। এসব দোকানে গিয়ে গেম খেলে নাই এমন ছেলে পাওয়া কঠিন। কিন্তু এ আসক্তি এতটা প্রকট অবস্থায় যায়নি। নিয়ন্ত্রিত সমাজ ব্যবস্থায় সেই প্রজন্মের কিশোর-তরুণরা প্রযুক্তির নেশায় আক্রান্ত হলেও তার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল। বর্তমান যুগে হাতে হাতে মোবাইল থাকায় পাবজি বা ফ্রি ফায়ারের মতো অনলাইন গেমস থেকে শুরু করে টিকটক বা লাইকির মতো অ্যাপে সময় নষ্ট করে অসংখ্য কিশোর-কিশোরীর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়ছে। ইন্টারনেটে সাইবার বুলিইংসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে তারা, হচ্ছে হয়রানির শিকার।

গত এক যুগে এ প্রজন্মের কিশোর-তরুণদের মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণগত অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ধীরতা, স্থিরতা ও ভব্যতার অভাব বাড়ছে। ফাস্ট ফ্যাশনের মতো ‘ফাস্ট ফেম’ এখন তাদের লক্ষ্য। এরাই যদি দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবে সমাজের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে, তা ভাববার বিষয়।

আধুনিক সভ্যতা ও প্রযুক্তির উদ্দেশ্য হলো জ্ঞান অন্বেষণ ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আত্মউন্নয়নের দ্বারা সমাজ পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উন্নয়নের সঙ্গে জীবনকে পরিবর্তন করা। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য উপকরণ আমাদের সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজš§কে আসলে কোনো দিকে ধাবিত করছে?

প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট

ইন্টিগ্রাল ডিজাইন স্টুডিওৃ