নাঈমা আকতার: ২০১৮ সালে একটা ব্রেইন সার্জারির পর আমার শব্দ সহনশীলতা অনেকটাই কমে গেছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২১-এ যখন ঢাকাবাসী আতশবাজি ফুটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার আনন্দে মেতে উঠেছিল, আমার জন্য তা ছিল ভয়ানক কষ্টের। পরদিন অবর্ণনীয় মাথাব্যথায় কাতর হয়ে কাটাতে কাটাতে ভাবছিলাম আমি নিশ্চয়ই একা নই। আরও অনেক মানুষ আছে যারা আমার মতোই কষ্ট পায়। যাদের অন্যের আনন্দের বলি হতে হয়। এর মধ্যেই দেখলাম রাজধানীর মোহাম্মদপুরে চার মাস ১৯ দিন বয়সের একটি শিশু আতশবাজির শব্দে অসুস্থ হয়ে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। শিশুটি জš§ থেকেই হƒদরোগে আক্রান্ত ছিল। আতশবাজির শব্দে তার সাডেন হার্ট ফেইলইউর হয়। এটাই কিন্তু প্রথম নয়। ২০১৮ সালে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে রাতের বেলা কোনো এক বিয়ে বাড়িতে উচ্চ শব্দের গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় ৬৫ বছরের এক অসুস্থ ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে বিয়েবাড়ির লোকরা।
এ কেমন আনন্দ? যে আনন্দে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে? যে আনন্দ মানুষের জীবন কেড়ে নেয়?
ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা অত্যন্ত ভয়াবহ। যেখানে শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৬০ ডেসিবেল, সেখানে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। এর কারণও একাধিক। যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন স্পিকারে গান বাজানো একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত উচ্চ আওয়াজে গান বাজানো যেন একটা স্বাভাবিক রীতি। সারারাত ধরে গান বাজালেও কেউ প্রতিবাদ করতে পারেন না। কর্মময় দিনের পরে মানুষের বাসায় ফিরে একটু বিশ্রামের উপায় নেই, পরদিন পরীক্ষা থাকলেও ছেলেমেয়েদের নির্বিঘেœ পড়ালেখা করার উপায় নেই। শুধু অনুষ্ঠানে নয়, কিছু এলাকায় কোনো কারণ ছাড়াই গান বাজতে থাকে সারা দিন-সারা রাত ধরে। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক আয়োজনে উচ্চ শব্দে একাধিক মাইকের ব্যবহার তো আছেই; যা শব্দদূষণকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
রাজধানীর রাস্তাঘাটে যানবাহনজনিত শব্দদূষণের কথা তো বলাই বাহুল্য। একটা সিগন্যালে আটকে গেলে গাড়ির হর্নের শব্দে কান পাতা দায়। যানজটে আটকে থাকলেও দেখা যায় যে গাড়িগুলো অবিরাম হর্ন বাজিয়েই চলেছে। অনেকে আবার আইন ভঙ্গ করে হাইড্রোলিক হর্নও ব্যবহার করছে। শুধু গাড়ি-মোটরসাইকেলই নয়, ইদানীং রিকশা-বাইসাইকেলেও এক ধরনের হর্ন ব্যবহার করতে দেখা যায়, যেগুলো তীব্র শব্দ তৈরি করে। এর সঙ্গে আছে নির্মাণকাজ। যে এলাকাগুলোতে নির্মাণকাজ চলে সেখানে দিনব্যাপী যে কি ভয়ানক যন্ত্রণায় এলাকাবাসী দিন পার করেন, তা তারাই ভালো জানেন। রাতের বেলা ট্রাকে করে নির্মাণসামগ্রী আনা, ইট-বালি-সুড়কি-রড ফেলার আওয়াজ, টাইলস্ কাটা, ড্রিল করা, মিক্সার মেশিনের ভয়ানক আওয়াজÑসারাদিন ধরে এসব চলতেই থাকে।
এভাবে প্রায় সব সময় শব্দদূষণের মধ্যে থাকার ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দদূষণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সাল নাগাদ এক তৃতীয়াংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে আক্রান্ত হবেন। শব্দদূষণে কানের স্বাভাবিক যে কার্যক্রম তা ক্রমাগত নষ্ট হয়ে বধিরতার দিকে এগিয়ে যায়। তাছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, হƒদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, কোনো কাজে মনোযোগী হতে না পারা ইত্যাদি বিভিন্ন রকম সমস্যা তৈরি হয়।
আবার আতশবাজির কথায় ফিরে আসি। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে আতশবাজির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ২০২১-এ আতশবাজি ও ফানুসের ব্যবহার ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ফানুসের থেকে এ বছর প্রায় ১০টি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এ আগুনের ঘটনা থেকে মানুষ মারা যায়নি ঠিকই কিন্তু সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। আর আতশবাজি! শব্দদূষণ তো আছেই, তার সঙ্গে গন্ধক, লোহাচুর, ক্যাডমিয়ামের মতো রাসায়নিক পুড়ে বায়ু দূষিত হয়ে শ্বাসনালি ও ফুসফুসের মারাত্মক রোগ হতে পারে। শুধু মানুষ নয়, আতশবাজির ভয়ংকর শব্দে পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীকূলের ক্ষতি সাধিত হয়ে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আতশবাজির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে বেশ কিছু পাখি একজনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। কিছু মানুষের কয়েক ঘণ্টার আনন্দ মানুষের মৃত্যুসহ কী অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছে ভাবা যায়?
যে পরিমাণ অর্থ এবার নগরবাসী বা দেশবাসী আতশবাজি ফুটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন, তা দিয়ে জনকল্যাণমূলক কিছু করা হলে অসংখ্য মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারত।
অথচ আমাদের কিন্তু আইন আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। আইন অমান্যের শাস্তিও আছে। প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) প্রতি বছর বিভিন্ন শহরের বসবাসযোগ্যতা নিয়ে জরিপ পরিচালনা করে থাকে। এ জরিপে যে বিষয়গুলো তারা প্রাধান্য দেয় তার মধ্যে অন্যতম হলো পরিবেশ, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও জীবনযাপনের মান। এ চারটিতেই ঢাকার পয়েন্ট কম থাকে নিশ্চয়ই, যার কারণে ঢাকা সব সময় বসবাসযোগ্যতার তলানিতে থাকে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান উপরের দিকে।
এ শহর আমাদের প্রাণের শহর। আমরা কেউই চাই না ঢাকা বসবাস অযোগ্য শহর, দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত হোক। শব্দদূষণ প্রতিরোধে উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রথমেই শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬-এর যথাযথ বাস্তবায়নে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে সচেষ্ট হতে হবে। যানবাহনজনিত যে শব্দদূষণে রাজধানীবাসীকে প্রতিনিয়ত নাকাল হতে হয়, সে জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও ট্রাফিক পুলিশকে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা প্রয়োজন। হাইড্রোলিক হর্ন দেশে নিষিদ্ধ হলেও তা আমদানি হচ্ছে। কাজেই কাস্টমসকে এক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। মোটরসাইকেল এবং ব্যক্তিগত গাড়ি আধিক্যের কারণে হর্নের পরিমাণও বেড়ে গেছে। কাজেই হাঁটা, সাইকেল চালানো ও গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কোনোভাবেই যেন পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ সভা-সমিতি-অনুষ্ঠানে মাইক বাজাতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে এবং এর অন্যথা হলে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে সব প্রক্রিয়া যেন ঘেরা দিয়ে সম্পন্ন করা হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখা আবশ্যক।
তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের নিজেদের সচেতন হওয়া। অযথা হর্ন বাজিয়ে, উচ্চ আওয়াজে মাইক বা স্পিকারে গান বাজিয়ে মানুষের যে ক্ষতি করা হচ্ছে, সে উপলব্ধি আসতে হবে নিজেরই। অসচেতন আচরণের কারণে একজন মানুষের কষ্ট হবে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে বা কেউ মারা যাবে, তা আমরা কেউই নিশ্চয়ই চাই না। শুধু অন্য মানুষের না, শব্দদূষণ যে করে, সে নিজেও কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাবের বাইরে নয়। কাজেই সমাজের সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনায় আমরা আরও সচেতন হবো, আনন্দের নামে শব্দ সন্ত্রাস বন্ধ হবেÑএই হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা।
উন্নয়ন কর্মী
naima_2810@yahoo.com