নিজস্ব প্রতিবেদক: কাগজ আমদানির আড়ালে আমদানি হচ্ছে জাল ব্যান্ডরোল। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকেন্দ্রিক একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে কাগজের মধ্যে লুকিয়ে জাল ব্যান্ডরোল আমদানি করছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এ-সংক্রান্ত কয়েকটি চালান আটক করেছে, যাতে রাজস্ব ফাঁকির সম্ভাবনা ছিল কয়েকশ কোটি টাকা। এর আগে জাল ব্যান্ডরোলের আরও ১৩টি চালান খালাস হয়েছে বলে ধারণা করছে কাস্টম হাউস কর্মকর্তারা।
গতকালও একটি চালান আটক করা হয়। এরই মধ্যে আটক করা চালানের আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। অপরাধী চক্রকে শনাক্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে এসব মামলা পুলিশের পিবিআই, সিআইডি বা র্যাবকে দিয়ে তদন্ত করাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহায়তায় চেয়ে কাস্টম হাউস। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে।

অপরদিকে সিগারেটের প্যাকেটে লাগানো হয় ব্যান্ডরোল। সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ এই ব্যান্ডরোল ছাপানো হয়। সেখান থেকে সিগারেট কোম্পানিগুলো ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করে। আর বাজারজাতের সময় ব্যান্ডরোলের ব্যবহার অনুযায়ী ভ্যাট বিভাগে শুল্ককর পরিশোধ করতে হয়। অর্থাৎ ব্যান্ডরোলের মাধ্যমে সিগারেট খাত থেকে কর আদায় করা হয়। আমদানি করা এসব জাল ব্যান্ডরোল কোন কোন কোম্পানি ব্যবহার করে, তা অনুসন্ধানে নেমেছে ভ্যাট গোয়েন্দা। মাঠ অফিসগুলো কোম্পানিগুলোর ব্যান্ডরোল তদারকি করে। এর পরও কোন কোম্পানি কীভাবে জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আট দিনের ব্যবধানে আবারও গতকাল জাল ব্যান্ডরোল জব্দ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চীন থেকে চট্টগ্রাম নগরীর জুবলি রোডের আমদানিকারক আরাফাত এন্টারপ্রাইজের এ-ফোর সাইজের ৮০ জিএসএম কাগজ আমদানি করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমসের এআইআর ইউনিট এই চালানটি আটক করে। দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে থাকা পণ্যের কন্টেইনারটি ফোর্স কিপ ডাউনের মাধ্যমে এআইআর টিম পরীক্ষা শুরু করে। এতে কন্টেইনারে থাকা ১২টি প্যালেট পরীক্ষা শেষে ১২০ কার্টন (নিম্নস্তর ১০৫ কার্টন ও মধ্যস্তর ১৫ কার্টন) এক কোটি ৬২ লাখ জাল ব্যান্ডরোল পাওয়া যায়। এসব ব্যান্ডরোল থেকে প্রায় ১৩০ কোটি টাকার রাজস্ব জালিয়াতির সম্ভাবনা ছিল।
এর আগে গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পাপ্পু এন্টারপ্রাইজ আর্ট পেপার ঘোষণায় এক কন্টেইনার পণ্য চালানে জাল ব্যান্ডরোল জব্দ করা হয়। এই পণ্য চালানটি খালাস হয়ে গেলে তিন কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার নি¤œস্তরের সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার করা যেত। এর মাধ্যমে সরকার প্রায় ৯০ কোটি থেকে ১৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব হারাত।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দিঘি এন্টি ফেইক কোম্পানি থেকে কাগজের নামে আনা সন্দেহজনক আরও ১৩ চালান চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগেই খালাস হয়ে গেছে। এসব চালানে সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারের জাল ব্যান্ডরোল থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বাপ্পি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জাল ব্যান্ডরোল আটক করার পর ফৌজদারি মামলা করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এই মামলা পিবিআই, সিআইডি বা র্যাবের মাধ্যমে তদন্ত করার ব্যবস্থা করতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস চিঠি দিয়েছে। সম্প্রতি কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম এই চিঠি দেয়, যাতে বলা হয় চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাপ্পি এন্টারপ্রাইজ। চীনের শেনজেন প্রদেশের দিঘি এন্টি ফেইক কোম্পানি থেকে কাগজ ঘোষণায় এক কন্টেইনার পণ্য আমদানি করে। প্রতিষ্ঠানের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড ৯ ডিসেম্বর পণ্য খালাসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। কাস্টম হাউসের পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় চালানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি হয়েছে বলে জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কাস্টম হাউসের এআইআর টিম চালানটি লক করে।
এতে আরও বলা হয়, ১৪ ডিসেম্বর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। পণ্য চালানে ঘোষণা ছিল ১৪ হাজার ৬৪০ কেজি আর্ট পেপার। কায়িক পরীক্ষায় ১২ হাজার ৭৬৭ কেজি আর্ট পেপার ও তিন কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস বা দুই হাজার ৩০৫ কেজি সিগারেটের জাল ব্যান্ডরোল পাওয়া যায়। এর আগে একই আমদানিকারক চীনের একই প্রতিষ্ঠান থেকে আরও তিনটি চালানে কাগজ আমদানি করেছে। একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে জাল ব্যান্ডরোল আমদানি করে আসছে, যার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত ও কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে মামলা পিবিআই, সিআইডি বা র্যাবকে দিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে। একইসঙ্গে মানি লন্ডারিং বিষয়ে এনবিআর, দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি যৌথভাবে তদন্ত করতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

অপরদিকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে তদন্তের জন্য পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরে বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামের একটি কোম্পানির মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেটের জাল স্ট্যাম্পের চালান খালাসের সময় আটকে দেয় চট্টগ্রাম কাস্টমস। চালানটি খালাস করতে পারলে প্রায় ১৩০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেয়া সম্ভব হতো।’ এ অভিযোগে গত শনিবার কোম্পানিটির বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম কাস্টমস বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে কোম্পানিটি এর আগেও এভাবে বিপুল ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।’
ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি বিস্তৃত পরিসরে তদন্তে অধিদপ্তরের যুগ্মপরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথাও জানান ড. মইনুল। তিনি জানান, কমিটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘চট্টগ্রাম কোতোয়ালির বাপ্পি এন্টারপ্রাইজ এর আগেও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েটসের সহায়তায় সাতটি বিল-অব-এন্ট্রি-তে ‘এ-৪ পেপার’ ঘোষণায় পণ্য খালাস করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, কোম্পানিটি এসব চালানেও একইভাবে জাল ব্যান্ডরোল খালাস করেছে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’ তদন্ত কমিটি কোন কোন সিগারেট কারখানা এসব ব্যান্ডরোল ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারে, তা অনুসন্ধান করবে। এ ঘটনার পর বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ব্যাংকের তথ্য জানাতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) অনুরোধ করা হয়েছে।