পদ্মা সেতুর সফল বাস্তবায়ন

আমাদের সততা ও আত্মবিশ্বাসের বিজয়

 মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: বাংলাদেশের গর্ব ও সাফল্যের প্রতীক এবং বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ পদ্মা সেতু ২০২২ সালের ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য উš§ুক্ত হয়। পদ্মা সেতুর স্বপ্নদ্রষ্টা ও রূপকার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্প দেশের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত সর্ববৃহৎ প্রকল্প।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত হলো দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, আর এ অবকাঠামোগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থা উন্নয়নে বিশেষ তৎপরতা লক্ষ করা যায়। সড়ক উন্নয়নের পাশাপাশি বৃহৎ নদ-নদীর ওপর সেতু নির্মাণেরও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী তথা পূর্বাঞ্চলকে বিভক্তকারী যমুনা নদীর ওপর ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘বঙ্গবন্ধু সেতু’ নির্মাণ এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম একটি সাহসী উদ্যোগ। এ সেতুর অধিকাংশ কাজ ১৯৯৮ সালে শেষ হলে তা যান চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করা হয়। অবশ্য রেললাইন, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হতে আরও কয়েক বছর সময় লাগে।

যমুনা সেতুর সফল বাস্তবায়নের পর কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনীতিতে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল লক্ষ করা যায়। উত্তরাঞ্চলের কৃষক, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীসহ আপামর জনগণের জীবনমান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীসহ পূর্বাঞ্চলের একটি নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের প্রথম মেয়াদে ১৯৯৯ সালে একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (Prefeasibility studz) মধ্য দিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। জাপান সরকারের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা পদ্মা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজে এগিয়ে আসে এবং ২০০৫ সালে প্রকল্পের ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ সমাপ্ত হলে এটি কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ দিকে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন হলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এ প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র-নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকম’কে (গঅটঘঝঊখ-অঊঈঙগ) ডিজাইন পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বিবিএ’র নিজস্ব প্রকৌশলী ছাড়াও এ প্রকল্পে কাজ করার জন্য সরকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগ ও রেলপথ বিভাগ থেকে কতিপয় অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ও সরকারের আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে কিছু কর্মকর্তাকে প্রেষণে পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিয়োগ দান করে। প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ও পরবর্তীতে নিয়োজিত ঠিকাদারদের কাজ তদারকি ও পরামর্শ প্রদানের জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্যানেল অব এক্সপার্টস (চঙঊ) গঠন করা হয়।

প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক কার্যাদি সম্পাদনের পর্যায়ে আমি সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি যোগদান করি এবং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে প্যানেল অব এক্সপার্টস, ডিজাইন পরামর্শক ও নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে সেতু প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাই।

এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও জাইকাÑএ তিনটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ঋণ সহায়তা প্রদান করেছিল। সে অভিজ্ঞতায় পদ্মা সেতুর প্রথম থেকেই এ তিন সংস্থা পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণ প্রদানে রাজি হয়। পরবর্তীতে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকও (আইডিবি) ঋণ প্রদানে এগিয়ে আসে। সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মতিতে প্রধান অর্থায়নকারী বিশ্বব্যাংককে অর্থায়নকারী সংস্থাসমূহের সমন্বয় কমিটির ‘টাস্ক টিম লিডার’ নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে ডিজাইন পরামর্শক নিয়োগের শুরু থেকেই যাবতীয় কাজ উন্নয়ন সহযোগীদের টাস্ক টিমকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন করা হতো, যদিও তাদের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরে কিছুটা সময় লাগে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ডিজাইন অনুযায়ী খরচ চূড়ান্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুর সংশোধিত ডিপিপি একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। এ সময় প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা বা ২৯৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে প্রকল্প সাহায্য ১৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা বা ২ হাজার ৩৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সরকারের অংশ (জিওবি) ৪ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা বা ৬১৭ মিলিয়ন ডলার। সংশোধিত ডিজাইন অনুযায়ী মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার, রোড ভায়াডাক্ট ৩.৮ কিলোমিটার, রেল ভায়াডাক্ট ০.৫৩২ কিলোমিটার অর্থাৎ সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১০.৪৮২ কিলোমিটার। নদীশাসন কাজ হবে ১৪ কিলোমিটার এবং উভয় দিকে সংযোগ সড়ক ১৫ কিলোমিটার।

উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে সরকারের নেগোসিয়েশনের পর তাদের প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ চূড়ান্ত করা হয়। ২০১১ সালের জুন মাসের মধ্যে চার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গেই ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিশ্বব্যাংক ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন, এডিবি ৬১৫ মিলিয়ন, জাপান/জাইকা ৪৩০ মিলিয়ন ও আইডিবি ১৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়, যথাÑ মূল সেতু, নদীশাসন, জাজিরা প্রান্তের অ্যাপ্রোচ রোড, সার্ভিস এরিয়া ও টোল প্লাজা, মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড ও টোল প্লাজা প্রভৃতি। ভৌত কাজের সব প্যাকেজের টেন্ডার আহ্বান, মূল্যায়ন ইত্যাদি যুগপৎ চলতে থাকে। এসব কাজে স্বচ্ছতার জন্য আমি প্যানেল অব এক্সপার্টসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে আলাদা আলাদা মূল্যায়ন কমিটি গঠন করে দিই। এসব কমিটিতে বুয়েটের অধ্যাপক, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, সরকারের বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা, বিশ্বব্যাংক মনোনীত পরামর্শক ও বিবিএ’র প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রাখা হয়। ভৌত

কাজ ছাড়াও প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট নিয়োগের প্রস্তাব মূল্যায়নের কাজও চলমান ছিল। ২০১৪ সালের মধ্যে সেতুর কাজ সমাপ্তির লক্ষ্যে সার্বিক কাজ দ্রুতগতিতে চলমান অবস্থায় ২০১১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংক (লিড পার্টনার) প্রকল্পে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তোলে এবং সেপ্টেম্বর থেকে প্রকল্পের কাজ স্থগিত করে দেয়।

সুপারভিশন কনসালট্যান্সির মূল্যায়ন চলাকালে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দুটি বেনামি (Fictitious) ই-মেইল আইডি থেকে বিশ্বব্যাংক ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (ওহঃ) বিভাগে অভিযোগ প্রেরণ করতে থাকে।

বিশ্বব্যাংক ওহঃ তাদের পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে সঠিকভাবে তদন্ত না করেই সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংকের

একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, ইন্টিগ্রিটি বিভাগের পরিচালকসহ একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দুর্নীতির আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করলে প্রধানমন্ত্রী তাদের সুনির্দিষ্ট লিখিত অভিযোগ দাখিল করতে বলেন।

এদিকে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্সির জন্য প্রতিযোগিতাকারী কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করে কানাডীয় রয়েল মাউন্টেড পুলিশের (আরসি এমপি) কাছে নালিশ করে। বিষয়টি জানাজানি হলে বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ অপ্রপ্রচার শুরু হয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের পর কয়েক মাস অতিবাহিত হলেও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেয়া কিংবা পদ্মা সেতুর প্রকল্পের স্থগিতকৃত কাজ পুনরায় শুরু করাÑএর কোনোটিই করেনি। টাস্ক টিমে কর্মরত এডিপি ও জাইকা প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করে জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পের এ পর্যন্ত সম্পাদিত কাজে কোনো ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ বা অনিয়ম হয়নি বলে তারা নিশ্চিত। কিন্তু যৌথ অর্থায়নকারী লিড পার্টনার সরে গেলে তারা অর্থায়ন করতে পারে না।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কোনো একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির প্রমাণ দিতে না পারলে তাদের টাকাই নেব না।’ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর কাজ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পাদিত হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করেন; উপরন্তু বিশ্বব্যাংকেও দুর্নীতি আছে বলে মন্তব্য করেন। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়ে দেয়, কানাডীয় পুলিশ এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে চলমান তদন্ত শেষ না করা পর্যন্ত সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে না। এ পর্যায়ে ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জয়েলিকের কার্যকালের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে।

বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের পর দেশের মিডিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আরও বাড়িয়ে দেয়। কতিপয় বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদ মত প্রকাশ করেন, বিশ্বব্যাংক তথা উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ সহায়তা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ঘোষণা করেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করব।’ তবে অর্থমন্ত্রী মিডিয়া ও কতিপয় সিভিল সোসাইটি সদস্যের মতামতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বব্যাংককে পুনরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরিয়ে আনার পক্ষে অবস্থান নেন এবং কয়েকজন নীতিনির্ধারণী পর্যারের সিনিয়র মন্ত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করে তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হন।

এদিকে কানাডীয় আরসিএমপি বিশ্বব্যাংকের আনীত অভিযোগ তদন্ত করে এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা করে। ওই মামলায় এসএনসি লাভালিনের কয়েকজন কর্মকর্তা, বাংলাদেশের একজন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও একজন বাংলাদেশি কানাডীয় নাগরিককেও আসামি করা হয়। বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরিয়ে আনতে অবশেষে বাংলাদেশে সরকার বিশ্বব্যাংকের কিছু কঠিন ও অনৈতিক শর্তে রাজি হয়ে যায়। সাবেক সেতু সচিব হিসেবে আমাকে চাকরি থেকে ছুটিতে পাঠায় এবং সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করে এবং বিশ্বব্যাংক নিয়োজিত তিন সদস্যবিশিষ্ট শক্তিশালী আইনজ্ঞ প্যানেলের চাপে এবং সরকারের একটি বিশেষ মহলের সম্মতিতে দুদক আমাকে প্রধান আসামি করে কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাজানো মামলা করে। দুদক আমাকে নিয়ে তিনজন ‘আসামিকে’ গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়। আমাকে সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর ফলে আমার ও আমার পরিবারের ওপর অসম্মান ও অবর্ণনীয় কষ্ট নেমে আসে। অবশ্য দুদকের এ পদক্ষেপ বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও মামলার আসামি করতে বলে। সরকারের বিশেষ মহল (যারা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছিল) উল্লিখিত উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে মামলার আসামি করতে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হলে প্রধানমন্ত্রী বিরক্ত হয়ে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

বিশ্বব্যাংক বলেছিল, একদিকে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তদন্ত চলবে এবং অন্যদিকে প্রকল্পের স্থগিত কাজ শুরু করা হবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক প্রতিশ্রুতিমতো পদ্মা সেতুর কাজে ফিরে আসেনি। তাদের গড়িমসির কারণে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ঋণ প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে (হালনাগাদ) সম্পাদিত কাজকর্মের ধারাবাহিকতায় যাবতীয় টেন্ডার কার্যক্রম সম্পন্ন করে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দান করে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মূল কাজের উদ্বোধন করেন। পিলার স্থাপনের কাজ শেষ হলে ২০১৭ সালে নদীর বুকে প্রথম স্প্যান স্থাপিত হয়। সর্বশেষ স্প্যানটি ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর স্থাপনের পর সেতুর কাঠামো দাঁড়িয়ে যায়। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত অবশিষ্ট কাজ যেমন কংক্রিটের তৈরি সড়ক সø্যাব ও রেল সø্যাব বসানো, রোড ও রেল ভায়াডাক্টগুলোর সঙ্গে সেতুর সংযুক্তকরণ, সেতুর ওপর সড়কপথের কার্পেটিং, ফেন্সিং, ল্যাম্পপোস্ট বসানোসহ আনুষঙ্গিক কাজ সমাপ্ত করে যান চলাচলের উপযোগী করে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হয়। সেতুর দুই প্রান্তে রেললাইন বসানোসহ রেল চলাচল উপযোগী করতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। নদীশাসন কাজ সমাপ্ত হতেও কিছুটা বিলম্ব হবে।

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের টানাপোড়েন, ঋণচুক্তি বাতিল ও দীর্ঘসূত্রতার ফলে সেতুর বাস্তব কাজ বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যায়। কাজ শুরু ও শেষ করতে বিলম্ব ও নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে টেন্ডার প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর ২০১৫ সালে সেতুর সর্বশেষ প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত সেতুর সার্বিক কাজের অগ্রগতি বিবেচনায় বোঝা যাচ্ছে, সেতুর মোট খরচ উল্লিখিত প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হবে।

পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব দুই থেকে চার ঘণ্টা কমে যাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন, কৃষির উন্নয়ন, কাঁচামালের সহজ প্রাপ্যতা, কৃষকগণ কর্তৃক তাদের উৎপাদিত দ্রব্যাদির সহজ সরবরাহ ও বাজারজাতকরণ প্রভৃতি সুবিধার ফলে দেশের সার্বিক জিডিপি বছরে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে বাড়বে এবং দক্ষিণাঞ্চলের জিডিপি ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়তে পারে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হবে। ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা, যশোর, খুলনা ও বৃহত্তর বরিশালের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। ঢাকা থেকে মাদারীপুর, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, মোংলা, বরিশাল, পায়রা ও কুয়াকাটা ইকোনমিক করিডোর স্থাপিত হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে (এন-৮) ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে আন্তঃবাণিজ্য সম্প্রসারণ ও যাত্রী পরিবহন সহজতর হবে। উন্নত সড়ক ও রেলপথকে কেন্দ্র করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও নতুন শিল্প এলাকা স্থাপিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষিত হবে। মাওয়া ও জাজিরায় নতুন নতুন রিসোর্ট, হোটেল, শপিংমল ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপিত হবে, পদ্মাপাড়ে নতুন শহর গড়ে উঠবে। বাগেরহাট, মোংলা, সুন্দরবন ও কুয়াকাটা যাতায়াত সহজ হলে আরও নতুন পর্যটন এলাকা স্থাপিত হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে পর্যটনশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। মোংলা ও পায়রা বন্দর বিস্তৃত আকারে সচল হবে, যেগুলো কয়েকটি প্রতিবেশী দেশও ব্যবহার করতে পারবে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সঙ্গে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছে সেতু বিভাগ। ১ শতাংশ সুদসহ এ ঋণ ৩৫ বছরে ১৪০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যে পরিমাণ যানচলাচল ও টোল আদায়ের হিসাব করা হয়েছে, তাতে আশা করা যায় ৩০-৩০ বছরের মধ্যে সেতু নির্মাণের খরচ উঠে যেতে পারে। যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের আগে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচলের যে সম্ভাব্য হিসাব করা হয়েছিল, বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার ফলে এর চেয়েও বেশি যান চলাচল ও টোল আদায় হচ্ছে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটবে বলে আশা করা যায়।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনয়নের ফলে আমাকে ও আমার পরিবারকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। সচিব থাকা সত্ত্বেও প্রায় তিন বছর মন্ত্রণালয়ের বাইরে এবং প্রায় দুই বছর দুর্নীতির মামলা চালাতে হয়েছে। দুদকের অধিকতর তদন্তে আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মামলা থেকে খালাস পাই। মহান আল্লাহতায়ালা ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা আমি আমার সম্মান ফিরে পেয়েছি এবং ত্যাগ স্বীকারের জন্য পুরস্কৃত হয়েছি। বিশ্বব্যাংক ও কানাডীয় পুলিশের দায়েরকৃত মামলাও কানাডা ফেডারেল কোর্ট ২০১৭ সালেই বাতিল করে দিয়েছেন। ওই মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের কথিত দুর্নীতির অভিযোগের তীর প্রধানমন্ত্রীর বোন শেখ রেহানা ও প্রধানমন্ত্রীর সন্তানদের ওপরও বর্ষিত হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধেও বিশ্বব্যাংক গোপনে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কোনো অনুসন্ধানেই কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প নিজের টাকায় বাস্তবায়ন করার সাহসী সিদ্ধান্ত ও কৃতিত্বের কারণেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সারাবিশ্বে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। এই একটিমাত্র আত্মবিশ্বাসী যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দৃঢ়চেতা, সফল, সৎ ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সারাবিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাহস ও আত্মবিশ্বাসের জয় হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সাফল্য এবং কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশসমূহের দৃষ্টিভঙ্গিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন সহযোগীরা বুঝতে পারে, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে তারা ভুল করেছে। এখন উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের বেশ কয়টি মেগা প্রকল্পে নিঃসংকোচে বিনিয়োগ করছে। জাপানের জাইকা শুধু তিনটি মেট্রোরেল প্রকল্পেই ১০৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ সহায়তা ছাড়া পদ্মা সেতু হবে না বলে যারা প্রচার ও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন এক অর্থে প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। গোটা জাতি আজ আনন্দে উদ্বেলিত। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত থাকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।

ই-মেইল: mosharraf212Íyahoo.com

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, সেতু বিভাগের সাবেক সচিব

ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান

বর্তমানে জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

আমার গ্রাম, আমার শহর

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনে পরিকল্পিত পথযাত্রা