আমানতের সঙ্গে আমানতকারী হারাচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান

রোহান রাজিব: এতদিন ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো (এনবিএফআই) আমানত হারাতো। তবে এখন আমানতের সঙ্গে আমানতকারীও হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তিন মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানত কমেছে ৫৪ কোটি টাকা। একই সময় প্রতিষ্ঠানগুলো আমানতকারী হারিয়েছে ৩৫ হাজারের বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালানাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মানুষের কাছে আস্থা আগেই হারিয়ে ফেলেছে। এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এতে জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে, কমছে প্রকৃত আয়। এসব কারণে আমানত ও ব্যক্তি আমানতকারীর হিসাব কমেছে। এছাড়া আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে সুদের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়ার কারণেও কমতে পারে বলে তারা জানান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। আর গত মার্চ শেষে আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ৫৪ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ। ৮টি বিভাগের মধ্যে আমানত কমেছে তিন বিভাগে। ঢাকায় আমানত কমেছে শূন্য দশমিক ৪১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং সিলেটে ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ কমেছে। তবে চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ, খুলনায় ১ দশমিক ৯২ শতাংশ, বরিশালে ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, রংপুরে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ময়মনসিংহে ১ দশমিক ৯০ শতাংশ আমানত বেড়েছে।

অন্যদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ২১ হাজার ৫৫৯টি। গত মার্চ শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৫৫৪টি। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে আমানতকারীর সংখ্যা কমেছে ৩৫ হাজার ৫টি বা ৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ আমানতকারী কমেছে ২৫ হাজার ৪০৬টি। আর মহিলা আমানতকারী কমেছে ৯ হাজার ৫৯৯টি। গত মার্চ শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৬১টিতে। এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বর শেষে হিসাব সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩২৬টি। একই সময়ে এসব হিসাবে অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কায়সার হামিদ শেয়ার বিজকে বলেন, প্রথম প্রান্তিকে আমানত ও

আমানতকারীর হিসাব কমেছে মূলত দু’টি কারণেÑ একটি হলো, চলতি মূলধনের ঘাটতি থাকায় ব্যবসায়ীরা টাকা উত্তোলন করে নিয়ে গেছেন। অপরটি হলোÑঅনেক আমানতকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে ব্যাংকে জমা করেছেন। কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ব্যাংকগুলো বেশি রেট দিয়েছে। আমাদের একটা সীমা থাকার কারণে বেশি রেট দিতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, আমানতের ক্যাপ থাকার কারণে আমরা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিলিয়ে রেট দিতে পারিনি। তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতিতে আমানত ও ঋণের ক্ষেত্রে করিডর দিয়েছে। ফলে আগামীতে ভালো একটি রেট দিতে পারব আমানতকারীদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। গত মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ২৩৯ কোটি টাকায়। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ঋণ বেড়েছে ৯১৮ কোটি টাকা বা ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।

বর্তমানে দেশে ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি সরকারি, ১২টি দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানায় এবং বাকিগুলো দেশীয় ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত। এর মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি বাদে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারল্য সংকটে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অন্তত ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এখন নাজুক।

জানা যায়, গত বছরের এপ্রিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ এবং আমানতে ৭ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যা ওই বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বলা হয়। খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আমানতের সুদের হার বেঁধে দেয়ার কারণে ব্যক্তি আমানতকারীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। তবে মুদ্রানীতিতে আমানত ও ঋণের সুদহার সীমা তুলে দিয়ে বাজারভিত্তিক করার ফলে এ খাতে আবার আমানত ফিরবে বলে আশাবাদী তারা।