আমার প্রাণের বর্ণমালা

কাজী সালমা সুলতানা: একুশে ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে যারা ছিলেন, তাদের প্রথম দলটি ধীর পায়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে এগিয়ে চলে। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয় সদর দরজা পর্যন্ত যেতেই পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। ক্রমশ পরিস্থিতি এমন হয় যে, চারদিকে ব্যাপক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আগের দিন যারা ১৪৪ ধারা ভাঙতে নাম লেখাননি এবং এর বিরোধী ছিলেন, তারাও নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে এগিয়ে যান। চারদিক থেকে গলা ফাটা স্লোগান চলতে থাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। উত্তেজনা, ক্রোধ, দুঃসাহস, ভয়, সংশয় স্লোগানের গগনবিদারী ধ্বনি-প্রতিধ্বনি  বিপর্যস্ত-উদ্বেলিত করে তোলে। ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে এত বেশি আগ্রহী এসে জমা হন যে, শেষ পর্যন্ত নাম লেখার সময়ও পাওয়া যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে তিনটি সত্যাগ্রহী দলকেই পুলিশ গ্রেফতার করে ও ট্রাকে তুলে নেয়। এক সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু করে। পুলিশের হামলায় আহত হন ড. সাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহারসহ আরও অনেকে। এর পরপরই দলে দলে ছাত্ররা পুলিশি হামলা ও বাধা উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসতে থাকেন। গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তাদের মধ্যে শামসুল হক দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। গ্রেপ্তারের যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়! পুলিশ বাহিনী কোনোভাবেই উত্তাল ঢেউয়ের মতো সংগ্রামী মিছিলকারীদের ঠেকাতে পারছিল না। আমতলা, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, ক্লাসরুম, শিক্ষকদের বিশ্রামাগার শত শত টিয়ারগ্যাসে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মুনির হোসেন, অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন চৌধুরীসহ অন্যান্য শিক্ষক পুলিশের নারকীয় অত্যাচারের তীব্র নিন্দা জানান এবং বিশ্ববিদ্যালয় তিন দিনের ছুটি ঘোষণা করেন। বেলা প্রায় ২টা পর্যন্ত মিছিল করে ছাত্ররা বীরত্বের সঙ্গে ফেব্রুয়ারি বরণ করতে থাকেন। ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার এক পর্যায়ে পুলিশ দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই আবদুল জব্বার, রফিকউদ্দীন আহমেদ শহীদ হন। আরও ১৭ জন গুরুতরভাবে আহত হন। গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির অচিন্তনীয় পরিবর্তন হয়। ছাত্রছাত্রীদের চোখে-মুখে যেন ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুন ঝরতে থাকে। মেডিকেল হোস্টেলের মাইকে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়। আইন পরিষদের সদস্যদের প্রতি ছাত্রদের গুলি চালানোর প্রতিবাদে অধিবেশন বর্জনের দাবি জানানো হয়। পুলিশের গুলি চালানোর সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে শহরের প্রান্ত থেকে প্রান্তে। সঙ্গে সঙ্গে অফিস-আদালত, সেক্রেটারিয়েট, বেতারকেন্দ্রের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করে বেরিয়ে আসেন। সারা শহর থেকে অসংখ্য মানুষ মেডিকেল হোস্টেল প্রাঙ্গণে এসে হাজির হয়। ততক্ষণে সব পুলিশ সরে গেছে। রাস্তা আর অলিগলিতে প্রবল বেগে বিক্ষুব্ধ মানুষের ঝড় বয়ে চলে। মেডিকেল হোস্টেলের ব্যারাকে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। মানুষের মন থেকে যেন সে সময় সব ভয়-ত্রাস মুছে চোখে-মুখে একুশে ফেব্রুয়ারির বর্বর হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধের দুর্জয় শপথ প্রকাশিত হয়।

(সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস)