বিআইডিএসের সম্মেলনের সমাপনী দিনে বক্তারা

আর্থিক খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রবৃদ্ধির জন্য চ্যালেঞ্জ হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: এতদিন যেসব উপাদানের ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, সেগুলো বর্তমানে কাজ করছে না। ফলে আগামী দিনে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। কেননা এখন কীভাবে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সে বিষয়ের একটি বড় অংশ রয়েছে জানার বাইরে। কিন্তু ২০৩০ সালে উচ্চমধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে এখনকার ব্যবস্থাপত্র কাজে লাগবে না। এ অবস্থায় তিনটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো। পাশাপাশি ব্যাংক খাতে সংস্কার, নগরায়ণ সংস্কার, রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। রপ্তানিতে শুল্ক-অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে।

গতকাল বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষণা সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বিভিন্ন অধিবেশনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। রাজধানীর লেকশোর  হোটেলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে একটি অধিবেশনে দুটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো গ্রোথ, ইমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড প্রভার্টি এবং এসকাপিং দ্য ফ্যামিলি স্যাডো: ইন্টার জেনারেশনাল মবিলিটি ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিস। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইউএসএ’র কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহ ইমন। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, বিশ্বব্যাংকের কনসালট্যান্ট নেরা ডিহেল, গায়েন্ত্রি কোলওয়াল এবং বিশ্বব্যাংকের জিওগ্রাফার লন্ডার বোস। অন্য একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন এবং বিআইডিএসের গবেষণা ড. কাজী ইকবাল।

গবেষণাপত্রের বিষয়ে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এতদিন যে কাঠামো দিয়ে দেশের অর্থনীতি এগিয়েছে এখনও কি সেই রকমই চলবে। নাকি নতুন ফ্রেকওয়ার্ক দরকার। যেমন কৃষিতে বোরে ধানের অবদান অনেক বেশি। এখনও কি সেটি থাকবে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন। দেখা গেছে, নব্বই দশকে বাংলাদেশে ইনোভেশন অনেক হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোকে সেটি ব্যাপক কমেছে। এর কারণ বের করতে ব্যাস্টিক, সাষ্টিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করা দরকার। সেই সঙ্গে সামাজিক বিশ্লেষণও জরুরি। কেন আগে ইনোভেশন বেড়েছিল এবং এখন কমেছে সেটি শুধু অর্থনৈতিক দিক  থেকে বিশ্লেষণ করলে চলবে না। এজন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দরকার। আগামী দিনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ক্ষেত্রে পলিসি এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সীমিত করলে হবে না। আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাইরেও একটি বড় শ্রেণি রয়েছে। যারা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার। ফলে ভারনাবিলিটি বিশ্লেষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে মানব পুঁজির উন্নয়ন এবং ইনোভেশন দরকার। যেমন এতদিন রেমিট্যান্স ও পোশাক খাত দিয়ে অর্থনীতি চলছি। কিন্তু আগামী ১০ বছরে এ দুটি দিয়ে চলবে কিনা। অদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চলা পোশাক খাত একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে গবেষণা করতে হবে। শিক্ষা মানে ব্যাপক ঘাটতি আছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা প্রকল্প আছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর কিনা সেটি বের করতে হবে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যেসব বিষয় দিয়ে চলছে, তা একটা সময় গিয়ে আর কাজ করবে না। উচ্চ আয়ের দেশে যেতে হলে এখানে পথ পরিবর্তন করতে হবে। ১৩০টি উন্নয়নশীল দেশের ওপর পর্যালোচনা করে তৈরি করা গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার আর্ন্তজাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন সূচকগুলো হিসাব করে দেখা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ব্যাপক সংস্কার হয়েছিল। যেমন আর্থিক খাত সংস্কার, রপ্তানি, এক্সচেঞ্জ রেট, অবকাঠামোসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কার হয়েছে। কিন্তু ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সংস্কারের ভূমিকা কমেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অতীতের সংস্কারের প্রভাব হিসেবে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সংস্কার প্রভাবের ভূমিকা পাওয়া যায়নি। এ সময় গড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হয়েছে সেটি জানা কঠিন। সেই প্রভাব খুঁজে বের করতে হবে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০-৩০ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হারে হতে পারে। কিন্তু তারপর কমে গিয়ে ৫ শতাংশের ঘরে যাবে। এ অবস্থায় উচ্চ মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়ের দেশে যাওয়া কঠিন হবে। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে নগরায়ণ সংস্কার জরুরি। বর্তমানে যেভাবে নগরায়ণ হচ্ছে এতে উৎপাদনশীলতা না বেড়ে বরং দূষণের কারণে কমে যাবে। এছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কার, রপ্তানি প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানো এবং অভ্যন্তরীণ অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার বলছে এলসি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ডলার বিক্রি বেড়েছে। আবার অনেক কম দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজারে যেখানে ১০০ টাকার ওপরে সেখানে সরকার বিক্রি করছে ৯৭-৯৮ টাকা দরে। এই বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করেই দেখা গেছে রেমিট্যান্স কমেছে। এর কারণ হলো ডলারের মাল্টিপুল রেইট কার্যকর। এতে যারা রেমিট্যান্স পাঠায় তারা হুন্ডিতে উৎসাহিত হয়েছে। এসব বিষয় ভেবে দেখতে হবে।

ড. বিনায়ক সেন বলেন, বিগ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরে আসতে হবে। আমাদের অন্য পথে যেতে হবে। যেসব সমস্যার সামাধন করা সম্ভব নয় বা কঠিন সেগুলো থেকে  দূরে থাকতে হবে। এছাড়া সেগুলো সমস্যা-সমাধান সম্ভব, সেগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। যেমন যানজট নিরসন সম্ভব এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা সম্ভব। নেপালের স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে আমরা কেন পারব না।

ড. কাজী ইকবাল বলেন, পরিবারের মধ্য যদি মা-বাবা শিক্ষিত ও অর্থশালী হন তাহলে তার পরবর্তী জেনারেশনও শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ পায়। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়ছে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থকেই এমন ব্যবস্থা নিতে হবে; যাতে শিক্ষায় বৈষম্য কমে যায়। তবে পরিবারভিত্তিক যথেষ্ট হালনাগাদ তথ্য নেই। ফলে বড়লোক বা শিক্ষিত পরিবারের সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।

অন্য একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বাঁধ নির্মাণ থেকে সরে আসার কথা অনেকেই বলেন। কিন্তু সেটি করা যাবে না। বরং এক্ষেত্রে উন্নত নানা পদ্ধতির ব্যবহার করে পুরোনো বাঁধ সংস্কার এবং নতুন বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সেটি করা না গেলে নি¤œ আয়ের দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।