মিজানুর রহমান:পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠে দিন শুরু হয়। সপ্তাহ গুনে মাস। এমনি করে মাস গুনে শেষ হয়ে গেল আরও একটি বছর-২০২৩। আর্থিক খাতের জ্বালানি হিসেবে পরিচিত ব্যাংক খাত পুরো বছরটি নানান ঘটনায় আলোচিত ও সমালোচিত ছিল। দেশের অভ্যন্তরে রেখে গেছে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সঙ্গে অনেক তিক্ত, সুমিষ্ট অভিজ্ঞতা এবং পথ দেখিয়ে গেছে অনাগত সমস্যা ও সম্ভাবনা।
২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদ লেনদেনবিহীন ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার ঘোষণা দেন। ২০ মার্চ এনপিএসবি বাংলা কিউআর লেনদেন চালু করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। দশটি ব্যাংক ও তিনটি মোবাইল কোম্পানি এ সার্ভিসে যুক্ত হয়ে মতিঝিলকে ক্যাশলেস ঘোষণা ও ঢাকার বাইরের জেলায় এ সার্ভিস চালু করে নতুন প্রত্যাশা ও উদ্যম তৈরি করেছিল।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত খেলাপি ঋণ মামলা ছাড়াই অবলোপন করার সুযোগ এবং খেলাপি ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি থেকে বের হওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, যা ব্যাংক পাড়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়।
কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এ সন্নিবেশিত ১১ক(ক) বিধান অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংক (বিআরপিডি) জারিকৃত সার্কুলারে ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে নিবন্ধিত সীমিতদায় পাবলিক ব্যাংক-কোম্পানির নামের শেষে ‘পাবলিক সীমিতদায় কোম্পানি’ বা ‘চখঈ’ অন্তর্ভুক্তকরণ এবং এ লক্ষ্যে সংঘস্মারক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনানুগ সম্পাদনা করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জš§ দেয়।
২০২৩ সালের পুরোটা বছর ছিল ডলার সংকট এবং দামও ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ১২৭ টাকা। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি খোলার নানান নীতিমালা করতে বাধ্য হয়েছিল। আমদানি এলসির পরিমাণ ছিল খুবই কম। এ সময় টাকায় এলসি খোলার অনুমোদন এবং ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড চালু করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে অনেক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়ী করেছিল সন্দেহের দোলা চলে, যা ছিল অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা।
বিদায়ী বছর ২০২৩-এ ব্যাংকের সুদের হার পুনর্নির্ধারিত হয়। সিঙ্গেল ডিজিট ৬-৯ শতাংশের ক্যাপ তুলে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। রেপো রেট এবং রিভার্স রেপো রেটসহ সব ধরনের ঋণের সুদের হার, রিজার্ভ গ্রহণের পদ্ধতি, মুদ্রা সরবরাহ নীতিসহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল যার আলোচনা-সমালোচনা চলমান।
ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন-২০২৩ অনুযায়ী, একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা ৪ জন থেকে ৩ জনে নামিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আর পরিচালক হিসেবে ৯ বছরের পরিবর্তে ধারাবাহিকভাবে ১২ বছর থাকতে পারবেন। একই পরিবারের তিনজনের বেশি পরিচালক হতে চাইলে লটারির মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
২০২৩ সালের শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। বিদায়ী বছরে মাত্র দুটি কোম্পানি আইপিও শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পেরেছিল, যা সর্বকালের সবচেয়ে কম। এক কথায় শেয়ারবাজার ভালো অবস্থায় ছিল না। ফ্লোর প্রাইজ দিয়ে বাজারকে এক প্রকার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। শেয়ার মার্কেটে এ বিষয় নিয়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে।
বিএবি’র উদ্যোগে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর নামে শেখ হাসিনা আন্তঃব্যাংক ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়। মাসব্যাপী এ খেলায় ৩৪টি ব্যাংক অংশগ্রহণ করে নতুন বিনোদনের ক্ষেত্র তৈরি করে আলোচনায় আসে । এ টুর্নামেন্টে কিছু পেশাদারি খেলোয়াড়কে নিয়মিত ব্যাংক কর্মকর্তা দেখানোর অভিযোগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যার জন্য সমালোচিত হয়। আল-আরাফাহ ব্যাংককে ২-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয় করে ইউনিয়ন ব্যাংক, যা ছিল সত্যিই উপভোগ্য।
এ বছর দেশের সাতটি বেসরকারি ব্যাংককে ‘নেতিবাচক’ রেটিং দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডি’স। এছাড়া ২০২৩-এ একাধিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদত্যাগ করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্যোগ প্রকাশ করেন এবং নতুন নীতিমালা জারি করেছিল, যা ছিল হতাশার মধ্যে ইতিবাচক।
বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকারদের জন্য ব্যাংকিং ডিপ্লোমার নাম পরিবর্তন ও তা বাধ্যতামূলক করে সার্কুলার জারি করে নতুন শিরোনাম তৈরি করে। যদিও তা পরে কিছুটা সংস্কার এনে ব্যাংক পাড়ায় স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছিল। এ ২০২৩ সালেই সরকার সর্বজনীন পেনশন চালু করে নতুনত্ব ও চমক সৃষ্টি করে।
২০২৩ সালে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাইবার হামলার হুমকির শিকার হয়। ধর্মভিত্তিক আন্ডারগ্রাউন্ড হ্যাকার গ্রুপ হামলার হুমকি দিয়ে ব্যাপক সতর্কতা জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাপক উদ্যোগ, আলোচনা ও সমালোচনার তৈরি হয়। বর্তমানে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি। চৌদ্দটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা যায় ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। এছাড়া পাঁচটি মূল ধারার ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি কাটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোটিশ দিয়েছিল, যা মিডিয়াতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করে।
সবচেয়ে আনন্দের খবর ছিল ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিগত লাইসেন্স প্রদান। নগদ টাকার ব্যবহার কমিয়ে আনার পাশাপাশি লেনদেনকে আরও সহজ করতে ডিজিটাল ব্যাংক চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সেই ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছিল ৫২টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তে পর্যবেক্ষক বসানোর নয় বছর পর ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেন। এ উদ্যোগ সবার কাছে প্রশংসিত হয়। একই সঙ্গে কয়েকটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আসন্ন ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশে অনেকের মাঝে চরম অস্বস্তি বিরাজ করে।
এছাড়া নানান কারণে আলোচনা সমালোচনায় ২০২৩-এ পুরো ব্যাংক পাড়া মুখরিত ছিল। সার্বিকভাবে, দেশের অর্থনীতি চাপে ছিল। কোভিড-পরবর্তী আর্থিক খাতের উত্তরণের বছরে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি ও মূল্যস্ফীতির জন্য আমাদের অর্থনীতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তথাপিও যায় দিন ভালো। উল্লেখিত সফলতা ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতায় আগামী নতুন বছর ভালোভাবে যেন কাটে সেটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ প্রার্থনা।
ব্যাংকার, কলাম লেখক