আর্সেনিক দূষণ ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

মো. আরাফাত রহমান: দেশের বিভিন্ন এলাকায় খাবার পানিতে আর্সেনিকের মাত্রাতিরিক্ত হার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। কিন্তু যখনই এই মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার থেকে বেশি হয়ে যায়, তখনই তা পানকারীর শরীরে নানা রকম রোগের উপসর্গ তৈরি করে এবং পরে সেসব রোগব্যাধিকে মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যায়। পুরো বিশ্ব থেকে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের মোটামুটি ২০টি ঘটনা জানা যায়। এর মধ্যে চারটি গুরুতর ঘটনাই পাওয়া গেছে এশিয়াতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী এক লিটার পানিতে ১০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানি দূষিত।

আর্সেনিক একটি বিষাক্ত খনিজ মৌলিক পদার্থ। এর কোনো স্বাদ বা গন্ধ নেই। অর্ধপরিবাহী ও সংকর ধাতু তৈরিতে আর্সেনিক ব্যবহƒত হয়। এটি মৌলিক পদার্থ হিসেবে থাকলে পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং বিষাক্তও হয় না। কিন্তু বাতাসে জারিত হয়ে অক্সাইড গঠন করলে এটি বিষাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষের দেহে, মৃত্তিকায় ও সমুদ্রের পানিতে সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক লক্ষ করা যায়। মাটির উপরিভাগের চেয়ে অভ্যন্তরে আর্সেনিক বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। মাটির নিচে পাথরের একটি স্তর আছে, যাতে পাইরাইটস নামে একটি যৌগ আছে। এই যৌগে আর্সেনিক বিদ্যমান। তবে সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক দেখা যায় শিলাখণ্ডের ভূ-ত্বকে। আর্সেনিক সালফাইড, অক্সাইড ও আর্সেনাইড আর্সেনিকের প্রধান উৎস বলে বিবেচিত। আমাদের দেশে আর্সেনিকের মূল উৎস হলো নলকূপের পানি।

দেশে বর্তমানে আর্সেনিক দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মাটির নিচে বিশেষ স্তরে আর্সেনিক সঞ্চিত থাকে এবং নলকূপের পানির মাধ্যমে তা উত্তোলিত হয়। বিগত কয়েক দশক ধরে কৃষি উৎপাদনে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে ফলে তা বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে নদী, নালা, খাল, বিল এবং সমুদ্রের পানি। এই অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার আর্সেনিক দূষণের একটি অন্যতম কারণ। মাটির বিশেষ যে স্তরে আর্সনোপাইরাইট নামক পদার্থ আছে, ভূ-গর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে তা পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। প্রতিদিন কৃষিকাজ থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহারের জন্য আমরা যে কোটি কোটি লিটার পানি উত্তোলন করি তাতে ভূগর্ভে যে সাময়িক শূন্যতার সৃষ্টি হয় এতে বায়ু এবং অক্সিজেনমিশ্রিত পানির সঙ্গে আর্সেনিক মিশে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে আর্সেনিক দূষণ।

বাংলাদেশের মান অনুযায়ী এক লিটার পানিতে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক থাকলে সেই পানিকে নিরাপদ পানি বলা হয় না। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বড়ঘরিয়া ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়। এরপর ২০০১ সালে ব্রিটিশ জিওলজিক্যাল সার্ভে বাংলাদেশের ৬১টি জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষা করে জানান ৪২ শতাংশ নলকূপের পানিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানের চেয়ে বেশি এবং ২৫ শতাংশ নলকূপের পানিতে বাংলাদেশের মানের চেয়ে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। দিনে দিনে তা ব্যাপক আকার ধারণ করে চলেছে।

২০১০ সালে ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক আছে এবং একজন ব্যক্তি কতদিন ধরে এই পানি পান করছেন, তার ওপর মৃত্যুঝুঁকি নির্ভর করে। আর্সেনিকের বিষক্রিয়া মৃত্যুর প্রধান কারণ না হলেও তা মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। প্রতিদিনের মোট আর্সেনিক গ্রহণ ও প্রস্রাবে আর্সেনিকের পরিমাণের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। পানিতে আর্সেনিক বেশি থাকলে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের কারণে সাধারণ রোগে গড়ে মৃত্যুঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুঝুঁকি ২৪ শতাংশ বেড়েছে। দীর্ঘস্থায়ী রোগে মৃত্যুহার বৃদ্ধিতে আর্সেনিকের সম্পৃক্ততার ব্যাপারটি আগেও যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, আর্জেন্টিনা, তাইওয়ান ও বাংলাদেশের মতলবে করা বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া গিয়েছিল।

প্রতি লিটার পানিতে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক পান করার ফলে ক্রনিক ডিজিজ, যথা ক্যানসার, হƒদরোগ ও ডায়বেটিসের মতো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুঝুঁকি ৬৪ শতাংশ বেড়েছে। সাধারণ রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে প্রায় সমপরিমাণে। গবেষকদের মতে, আর্সেনিকযুক্ত পানি পান না করলে এই মৃত্যু কম হতো। আর্সেনিক পানরত ব্যক্তির আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় যকৃৎ, ত্বক, কিডনি, ফুসফুস ও হƒৎপিণ্ডের ক্যানসার হতে পারে। আর্সেনিকের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন জনের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বিভিন্ন রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এমনকি রোগের প্রকোপ ঠেকাতে অনেকের হাত-পায়ের আঙুলও কেটে ফেলতে হচ্ছে।

২০১০ সালের ২২ মার্চে বাংলাদেশ সরকার ও ইউনিসেফ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ৫৪টি জেলার নলকূপের পানি পরীক্ষার তথ্য পরিবেশিত হয়। এ থেকে জানা যায়, ৪৭টি জেলার ২৩৩টি উপজেলার দুই হাজার ইউনিয়নের ৩১ হাজার ৪৯৭ গ্রাম আর্সেনিক দূষণের শিকার। বাংলাদেশের মান অনুযায়ী যেসব এলাকায় পাঁচ শতাংশ নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যায়, সেসব এলাকাকে আর্সেনিক দূষণের শিকার এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়। এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক, যশোরের দেয়া তথ্যমতে যশোর জেলায় আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার জন। জেলার শার্শা, চৌগাছা ও ঝিকরগাছায় এই প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এমনকি উপজেলাগুলোর কয়েকটি গ্রামে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষই আক্রান্ত।

মানুষের দেহে আর্সেনিকের লক্ষণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ পায় না। অনেক ক্ষেত্রে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় ছয় মাস বা তারও পরে। পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক আছে তার ওপর ভিত্তি করে এর বিষক্রিয়া প্রকাশ পায়। বেশি মাত্রায় আর্সেনিক-মিশ্রিত পানি অনেক দিন ধরে পান করলে এর লক্ষণ প্রকাশ পায় দ্রুত। প্রথমে দেহে কিংবা হাতের তালুতে বাদামি ছোপ দেখা যায়। পরে হাতের আঙুলগুলোয় পচন ধরে। অনেক সময় আর্সেনিকের প্রতিক্রিয়ার ফলে মানুষের পায়ের তালুর চামড়া পুরু হয়ে যায় এবং আঙুলগুলোও বেঁকে যায়। আর্সেনিক-আক্রান্ত ব্যক্তি ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারে। আর্সেনিক-আক্রান্ত রোগীর জিব, মাড়ি ও ঠোঁটে লালভাব দেখা যায়। রোগী ক্ষুধামান্দ্য, খাদ্যে অরুচি ও বমি-বমি অনুভব করে। ধীরে ধীরে হƒদযন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। মানুষের রক্তে শ্বেত ও লোহিত কণিকার পরিমাণ কমে যায়। অনেক সময় রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত ও গর্ভবতীদের ভ্রুণের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশে আর্সেনিকযুক্ত পানি আর্সেনিকমুক্ত করার একটি সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি রয়েছে, যাকে বলা হয় তিন কলসি পদ্ধতি। এজন্য তিনটি কলসি একটির ওপর অপরটি রাখতে হয়। সবচেয়ে ওপরের কলসিতে রাখতে হয় লোহার কণা ও মোটা দানার বালি। মাঝখানের কলসিতে রাখতে হয় কাঠ-কয়লা ও মিহি দানার বালি এবং একেবারে নিচের কলসি থাকবে খালি। আর্সেনিকযুক্ত পানি এনে ঢালতে হবে সবচেয়ে ওপরের পাত্রে, যা ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার, বিশুদ্ধ ও আর্সেনিকমুক্ত হয়ে জমা হবে সবচেয়ে নিচের কলসিতে। এই পদ্ধতিতে আর্সেনিকের মাত্রা অনেক নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব।

পানির অপর নাম জীবন। মানুষের জীবনরক্ষাকারী পানি আজ বিষাক্ত হয়ে পড়ছে আর্সেনিকের কারণে। আর্সেনিকযুক্ত পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। ৩০ বছর আগেও দেশের অগভীর নলকূপের পানি বিশুদ্ধ ছিল, কিন্তু ক্রমেই তা আর্সেনিক দ্বারা

আক্রান্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার কোনো চিকিৎসা নেই। আর্সেনিক বিষক্রিয়া থেকে মুক্তির জন্য আপাতত প্রতিরোধক ব্যবস্থাই সবচেয়ে উপযোগী।

বিজ্ঞানীরা আর্সেনিক-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ মিলিগ্রাম আর্সেনিক মানুষের দেহের জন্য সহনীয় বলা হলেও বর্তমান রিপোর্টে বলা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য এ মাত্রা শূন্য দশমিক শূন্য এক মিলিগ্রামের বেশি হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাই প্রতিরোধ ও প্রতিকারের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণায় দেখা যায়, কম গভীরতাসম্পন্ন নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি। বিশেষ করে ১০০-২০০ মিটার গভীরতায় আর্সেনিকের উপস্থিতি কম। আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ এবং প্রতিকারে কিছু ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। যেমন গভীর নলকূপের পানি খাবার এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করতে হবে। বৃষ্টির পানিতে আর্সেনিক থাকে না। তাই বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে ব্যবহার করতে হবে। গণমাধ্যম ও গ্রামীণ অনুষ্ঠানে আর্সেনিক সম্পর্কে সচেতন করা প্রয়োজন। পুকুর ও খাল-বিলের পানিতে আর্সেনিক থাকে না। তাই পুকুর, খাল বা বিলের পানি ছেঁকে ২০ মিনিট ফুটিয়ে পান করা উচিত। আর্সেনিক-আক্রান্ত গ্রামে পুকুর খনন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি সহায়তার মাধ্যমে আর্সেনিক বিশোধন প্লান্ট স্থাপন করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় পরপর নলকূপের পানি পরীক্ষা করতে হবে। বালতি, কলস ও যৌথ প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত ফ্লাই অ্যাশ দিয়ে ফিল্টারের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা উচিত। কাছে আর্সেনিকমুক্ত নলকূপ পাওয়া না গেলে পুকুর বা নদীর এক কলসি পানিতে আধা চামচ ফিটকিরি মিশিয়ে দু-তিন ঘণ্টা রেখে দিয়ে পরে ওপর থেকে তলানিবিহীন পরিষ্কার পানি পান করতে হবে।

আর্সেনিক কোনো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগ নয়, তাই আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের কাছে পরামর্শ নিতে হবে। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও গ্রাম পর্যায়ে আর্সেনিক থেকে মুক্ত থাকার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করতে হবে। খাবার পানির মাধ্যমে আর্সেনিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে, তাই আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে।

সহকারী কর্মকর্তা ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়