মো. জিল্লুর রহমান: ফিলিস্তিনি তরুণ-তরুণীসহ অনেকেই হাসতে হাসতে মসজিদুল আকসার জন্য আহত ও জীবন উৎসর্গ করেছে। এ ধরনের ছবি প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়ায় এবং এ আল আকসা মসজিদ নিয়েই ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ। ফিলিস্তিনিরা নিজ জন্ম ভূমিতে পরাধীন এবং আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে শুধু পাথর ও কিছু স্বল্প মাত্রার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যুগের পর যুগ লড়াই করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলে আকস্মিক হামলা চালিয়ে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আসলে আমরা অনেকেই এর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করি না বা করতে সমর্থ হই না।
আল আকসা মসজিদ শুধু ফিলিস্তিন বা মধ্য প্রাচ্যের কাছে নয়; বরং সমগ্র মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি তাদের ভালোবাসা ও প্রাণের স্পন্দন। এটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা এবং পৃথিবীতে নির্মিত দ্বিতীয় মসজিদ যা মসজিদুল হারামের পরে নির্মিত হয়। কুরআনে মিরাজের ঘটনা উল্লেখ করার সময় এই স্থানের নাম নেয়া হয়েছে। খোলাফায়ে রাশিদুনের পরেও ইসলামি পণ্ডিতরা একে ঐতিহ্যগতভাবে আল ইসরা বলে উল্লেখ করেছেন। সুরা বনী ইসরাইলের ১নং আয়াত আল আকসার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই আয়াতে বলা হয়েছে পবিত্র ও মহিমময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তিনের) মসজিদুল আকসায়। এ আয়াতটির অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় প্রায় সব পণ্ডিতই সুনির্দিষ্টভাবে আল আকসা ও মসজিদ আল হারাম-এর উল্লেখ করেছেন।
আল আকসা মসজিদটি ২৭ একর জমির ওপর অবস্থিত। পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন মসজিদের সমন্বয়ে গঠিত পুরো কম্পাউন্ডটি। মসজিদ এ কিবলি, মসজিদে মারোয়ানি, মসজিদুল করিম, মসজিদুল বোরাক, তুব্বাতুর সাকরাম এই পাঁচটি মসজিদের সমন্বয়ে এই পুরো কম্পাউন্ড। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এটাকে জামাত হওয়া ও প্রস্থান করার স্থান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নবী করিম (সা.) এর আগমনের পর হুজুরের বাহন বোরাক যেখানে দাঁড়ায়; সেখানে যে মসজিদ স্থাপন করা হয় তার নাম বোরাক। যে স্থান থেকে মিরাজ সংঘটিত হয় সেই স্থানকে বলে মেহরাব উব্বাতুন নবী।
জেরুজালেম ইসলামের অন্যতম পবিত্র স্থান। কুরআনের অনেক আয়াতই জেরুজালেমকে নির্দেশ করেছে যার কথা একদম শুরুর দিকের ইসলামি পণ্ডিতরাও বলেছেন। জেরুজালেমের কথা হাদিসেও অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে অবস্থিত মসজিদুল আকসা মুসলমানদের তৃতীয় সম্মানিত মসজিদ এবং একথা মধ্যযুগের অনেক লিপিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন, একজন লোক ঘরে নামাজ পড়লে একটি নেকি পান, তিনি ওয়াক্তিয়া মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জুমা মসজিদে পড়লে ৫০০ গুণ, মসজিদে আকসায় পড়লে ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে অর্থাৎ মসজিদে নববীতে পড়লে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারাম বা কাবার ঘরে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাবেন। (ইবনে মাজা, মিশকাত)। ধর্মীয় কারণে যে তিনটি স্থানে সফরের কথা হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন এই স্থানটি তš§ধ্যে অন্যতম। বাকি দুটি স্থান হলো মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী। ওআইসি ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে আল আকসা মসজিদকে গণ্য করে এবং এর ওপর আরবদের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি করে।
‘ইসরা’ শব্দের অভিধানিক অর্থ হলো রাতে ভ্রমণ। মেরাজ শব্দটি আরবি ভাষার উরুজ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ উন্নতি বা ঊর্ধ্বে ওঠা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত সফরকে ‘ইসরা’ এবং মসজিদুল আকসা থেকে আরশে আজিমে (ঊর্ধ্বাকাশ) সফরকে মিরাজ বলা হয়। যে রাতে নবী মুহাম্মদ (সা.) ঐশ্বরিক উপায়ে ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেছিলেন এবং আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সেই রাতই হলো শবে মেরাজ। ইসলামে মিরাজের বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে, কেননা এই মিরাজের মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ অর্থাৎ নামাজ মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক (ফরজ) নির্ধারণ করা হয় এবং দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান প্রচলন করা হয়।
কুরআন ও ইসলামি বিবরণ অনুযায়ী আল আকসা মসজিদে মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে, বিদ্যুৎ ও আলোর চেয়ে দ্রুতগামী বাহন বোরাকে চড়ে এসেছিলেন। মিরাজ শেষে নবী (সা.) প্রথম বায়তুল মোকাদ্দিসে অবতরণ করেন। সেখান থেকে বোরাকে করে প্রভাতের আগেই মক্কায় পৌঁছেন। নবী (সা.) এর নবুওয়াত প্রকাশের একাদশ বছরের (৬২০ খ্রিষ্টাব্দ) রজব মাসের ২৬ তারিখের দিবাগত রাতে প্রথমে কাবা শরিফ থেকে জেরুজালেমে অবস্থিত বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসায় গমন করেন। তিনি এখানে নামাজ পড়েন এবং তার পেছনে অন্যান্য নবী রাসূলরা নামাজ আদায় করেন। অতঃপর তিনি বোরাকে (বিশেষ বাহন) আসীন হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গমন করেন। ঊর্ধ্বাকাশে সিদরাতুল মুনতাহায় তিনি আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ করেন। ফেরেশতা জিব্রাইল পুরো যাত্রায় তার সঙ্গে ছিলেন। সব মুসলমান বিশ্বাস করেন, সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। সুরা বনী ইসরাইলের প্রথম আয়তটিতে ‘সোবহান’ শব্দটি ব্যবহƒত হয়েছে। আরবি ভাষায় বিস্ময়কর সংবাদের ক্ষেত্রে ‘সোবহান’ শব্দ ব্যবহƒত হয়। এখানে ‘আবদ’ (বান্দা) শব্দটি দ্বারা আত্মা ও দেহ বোঝানো হয়েছে, শুধু আত্মাকে নয়।
আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত: আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোনো মসজিদ তৈরী করা হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। আমি বললাম, উভয় মসজিদের (তৈরির) মাঝে কত ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন, ৪০ বছর। অতঃপর তোমার যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই সালাত আদায় করে নেবে। কেননা এর মধ্যে ফজিলত নিহিত রয়েছে। (সহিহ বোখারী, হাদিস নং ৫৮৫)।
নবী দাউদ (আ.) যখন জীবিত ছিলেন তখন তিনি আল্লাহর নবী ও বাদশা ছিলেন। ৩০ বছর বয়সে তার নবুয়াতপ্রাপ্তির পর ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি আল্লাহর ধর্ম প্রচারে নিমগ্ন ছিলেন এবং শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। জীবন সায়াহ্নে উপস্থিত হয়ে তিনি রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিদের ডেকে বললেন, আমার জীবনের একটি প্রধান বাসনা ছিল, আমি আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য একখানা পবিত্র গৃহনির্মাণ করব এবং এর জন্য আমি প্রয়োজনীয় স্বর্ণ, রুপা, তামা, পিতল, লোহা, কাঠ, পাথর ইত্যাদি সংগ্রহ করে রেখেছি। তারপর তিনি পুত্র সোলাইমানকে (আ.) এই পবিত্র গৃহনির্মাণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করলেন এবং এই কার্যের গুরুত্বের বিষয়টি অবহিত করলেন। তিনি হজরত সোলায়মানকে বারবার বললেন, স্মরণ রেখ, এটা বাসগৃহ নয়; এটা আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত গৃহ।
আল্লাহর অসীম রহমতে নবী সোলায়মান (আ.) এমন কারামাত লাভ করেছিলেন, যা দুনিয়ার সব পশু-পাখি, জিন এবং বায়ুমণ্ডল পর্যন্ত তার পরম অনুগত ও বাধ্য ছিল। একান্ত আজ্ঞাবহরূপে এরা সবাই তার হুকুম তামিল করত। নবী সোলায়মান (আ.) পিতার মনের বাসনা পূর্ণ করতে বদ্ধপরিকর হলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সুযোগ্য প্রস্তরশিল্প এবং বিভিন্ন শ্রেণির প্রখ্যাত কারিগরদের এনে বিরাট অট্টালিকা নির্মাণ করলেন। নানাবিধ উপকরণ দিয়ে সুসজ্জিত করা হলো। এর জন্য জিনদের দ্বারা গহিন সাগরের তলদেশ থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। প্রাচীর গাত্রে এবং উপরিভাগে গাছ ও ফেরেশতাদের চিত্রাঙ্কন করা হলো। ছাদে সোনা, রুপা, মোতি, হীরা পান্না, ইয়াকুত, ফিরোজা প্রভৃতি ধাতু ও প্রস্তরগুলো খচিত হয়ে সুরম্য মসজিদ গৃহের শোভা শতগুণ বৃদ্ধি পেল। বনি ইসরাইল কওমের ধার্মিক লোকজন এ বায়তুল মুকাদ্দাস বা পবিত্র ইবাদত গৃহে আল্লাহ তায়ালার উপাসনায় মগ্ন হলো।
মুসলমানদের কাছে আল আকসা মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রথম দিকে মুসলমানরা এ স্থানকে কিবলা হিসেবে ব্যবহার করত। হিজরতের পরে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ায় এর পরিবর্তে কাবা নতুন কিবলা হয়। মসজিদ আল কিবলাতাইনে নামাজের সময় এই আয়াত নাজিল হয়। এরপর থেকে কাবা কিবলা হিসেবে ব্যবহƒত হয়ে আসছে। প্রথম দিকের মুফাসসিরদের মতে, ৬৩৮ সালে জেরুজালেম বিজয়ের পর উমর (রা.) প্রবেশের সময় কাব আল আহবারের থেকে পরামর্শ নিয়েছিলেন, মসজিদ তৈরির জন্য সবচেয়ে উত্তম জায়গা কোনটি হতে পারে। তিনি ছিলেন একজন ইহুদি থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি যিনি মদিনা থেকে তার সঙ্গে এসেছিলেন। তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে এটি কুব্বাত আস-সাখরার (ডোম অব দ্য রক) পেছনে হওয়া উচিত এবং এর ফলে গোটা জেরুজালেম আপনার সামনে থাকবে। উমর প্রত্যুত্তর দিলেন, তোমার মতো ইহুদিবাদের সঙ্গে মিলে গেছে! এই কথোপকথনের পরপরই উমর একটি স্থান পরিষ্কার করতে শুরু করলেন। যেটি আবর্জনা ও রাবিশে পরিপূর্ণ ছিল। তিনি তার জোব্বাটি ব্যবহার করলেন এবং অন্য সাহাবারা তাকে অনুকরণ করল যতক্ষণ না জায়গাটি পরিষ্কার হয়েছিল। উমর এরপর সেই স্থানে নামাজ পড়লেন যেখানে নবী (সা.) মেরাজের আগে নামাজ পড়েছিলেন বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকে। বর্ণনা অনুসারে উমর সেই স্থানটিকে মসজিদ হিসেবে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। যেহেতু দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.) এর প্রার্থনার স্থান হিসেবে পূর্ব থেকেই এটি একটি পবিত্র উপাসনার স্থান, তাই উমর স্থাপনাটির দক্ষিণস্থ কোইে এটি নির্মাণ করেন। যাতে কুব্বাত আস-সাখরা (ডোম অব দ্য রক) মসজিদটি ও কাবার মধ্যস্থানে না পড়ে যায় এবং মুসলমানরা নামাজের সময় একমাত্র মক্কার দিকেই মুখ করতে পারে।
আল আকসা মসজিদের এলাকা অসংখ্য নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত, এর আশপাশে অনেক নবী-রাসুলের সমাধি রয়েছে। এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে দ্য গ্রেট সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবীর অসংখ্য স্মৃতি। এই মসজিদের পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে সম্পূর্ণ সূরা ইয়াসিন। এটি দীর্ঘকালের ওহি অবতরণস্থল, ইসলামের কেন্দ্র এবং ইসলামি সংস্কৃতির চারণভূমি ও ইসলাম প্রচারের লালনক্ষেত্র। এটি মুসলিম উম্মার ভালোবাসা ও প্রাণের স্পন্দন।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক
rbbbp@gmail.com