Print Date & Time : 15 August 2025 Friday 9:57 am

আশ্রয়ণ প্রকল্প: মুজিববর্ষে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার

এমএ খালেক: খুলনার ডুমুরিয়ার রিনা পারভিন (৩০) নতুন প্রাপ্ত সেমি পাকা ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় তিনি একটি সেমি পাকা ঘর এবং দুই শতাংশ জমির মালিকানা পেয়েছেন। তার অনুভূতি জানতে চাইলে রিনা পারভিন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, কোনো দিন নিজের বাড়ি হবে তা ভাবতেও পারেননি। স্বামী-সন্তান নিয়ে কখনও রাস্তায়, কখনও অন্যের বাড়ির বারান্দায় কষ্ট করে রাত কাটিয়েছেন। আবার কখনও বা খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করেছি। সমাজে আমাদের কোনো মান-সম্মান ছিল না। সবাই অবজ্ঞা করত। প্রধানমন্ত্রীর উপহার জমিসহ একটি সেমি পাকা ঘর পেয়ে আমি খুবই খুশি। কান্নাবিজরিত কণ্ঠে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের বাড়ি দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাকে অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুন, এই কামনা করি।

নীলফামারীর সৈয়দপুরের শাহিনা আক্তার নতুন কাপড় পরে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় প্রাপ্ত সেমি পাকা ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন। উদ্বোধন উপলক্ষে ঘরগুলোকে রঙিন কাগজ দিয়ে মনোরমভাবে সাজানো হয়েছিল। একসময় যা ছিল শুধুই স্বপ্ন, আজ তা-ই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে গৃহহীন ও ভূমিহীন সবার জন্য বাড়ি নির্মাণ কার্যক্রমের আওতায় শাহিনার পরিবার একটি ঘর পেয়েছে। ‘আইজ হামারগুলার ঘরে ঘরে আনন্দ। খুব খুশি নাগছে। আমি খুব খুশি। সবাক মিষ্টি খাওয়ামো,’ স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে এভাবেই শাহিনা তার অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন। তিনি বারবার প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করছিলেন।

শুধু রিনা পারভিন বা শাহিনা আক্তারই নন, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে মুজিববর্ষে সবার জন্য বাড়ি কার্যক্রমের আওতায় পাকা বাড়িপ্রাপ্তদের সবার অনুভূতি অনেকটা একই রকম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই ঘোষণা করেছিলেন, মুজিববর্ষে গৃহহীন সবার জন্য পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি। কারণ এত বড় একটি কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা সহজ কথা নয়। কিন্তু আজ সেই কল্পনাতীত বিষয়টিই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। পাকা বাড়িপ্রাপ্ত গৃহহীন পরিবারগুলোর অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেক গৃহহীন পরিবারের জন্য পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দেয়া মুজিববর্ষে আমাদের সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। আমরা সেই অঙ্গীকার পূরণ করেছি মাত্র। তিনি আরও বলেন, নিজস্ব বাড়ি থাকা একটি মানুষের মৌলিক অধিকার। সরকার হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ছিল সেই অধিকার বাস্তবায়ন করা। মুজিববর্ষে একটি পরিবারও গৃহহীন থাকবে না, আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি। তিনি আরও বলেন, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই হবে মুজিববর্ষের লক্ষ্য, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পায়। দেশের গৃহহীনদের ঘর দিতে পারার মতো বড় উৎসব আর কিছু হতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৩ জানুয়ারি সকালে মুুজিববর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান কার্যক্রমের অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে এ কথা বলেন। সরাসরি উপস্থিতি থেকে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এর উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘করোনার কারণে মুজিববর্ষের অনেক কার্যক্রমই আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কিন্তু একদিকে করোনা আমাদের জন্য আশীর্বাদও হয়েছে, কারণ করোনার কারণে আমরা অন্য সব প্রকল্পে সেভাবে মনোযোগ দিতে না পারলেও গৃহহীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ার সুযোগ পেয়েছি।’ 

এটি ছিল বিরল ও সাহসী জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম। কারণ বিশ্বের কোনো দেশই এত কম সময়ের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের একটি কল্যাণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে দৃঢ় মনোবল প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী সেই দৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিয়েই এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেন। বাংলাদেশের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য যে পাঁচটি মৌলিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আবাসন সুবিধা প্রাপ্তি অন্যতম।

বর্তমান সরকার সবার জন্য আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। গত ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ঘর প্রদান করেন। এছাড়া একই সময়ে তিন হাজার ৭১৫টি পরিবারকে ব্যারাকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। সরকার এক হাজার ১৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব বাড়ি নির্মাণ করেছে। পর্যায়ক্রমে আরও মোট আট লাখ ৮৫ হাজার ২২২টি পরিবারকে ঘর তৈরি করে দেয়া হবে। উপকারভোগী প্রতিটি পরিবারকে দুই শতাংশ খাসজমি ও দুই কক্ষবিশিষ্ট সেমি পাকা ঘর দেয়া হয়েছে। জমির নিবন্ধন, নামজারি প্রভৃতি যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সরকারের পক্ষ থেকেই সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রতিটি দুই কক্ষের সেমি পাকা টিনশেড বাড়িতে রান্নাঘর, শৌচাগার, বারান্দা, বিদ্যুৎ, পানিসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্রোথ সেন্টারের পাশে হওয়ার কারণে প্রকল্প এলাকায় পাকা রাস্তা, স্কুল, মসজিদ, মাদরাসা ও বাজার রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রাম এলাকায় যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর নির্মাণ বন্ধ করে তার পরিবর্তে গ্রামের একটি নির্দিষ্ট এলাকা, যেখানে সাধারণত কোনো ফসল উৎপাদিত হয় না, সেখানে পরিকল্পিতভাবে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আজকে আবাদি জমি রক্ষার যে আন্দোলন, তা বঙ্গবন্ধুই প্রথম শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পিত গুচ্ছগ্রামে সব ধরনের আধুনিক নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথা ছিল। গুচ্ছগ্রাম কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য আধুনিক জীবন-যাপন পদ্ধতি নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে গ্রামের উর্বর ফসলি জমির অনুৎপাদনশীল ব্যবহার বন্ধ করা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাঁর সেই গুচ্ছগ্রাম কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্প নামে যে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, তা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের গুচ্ছগ্রাম পদ্ধতিরই পরিবর্তিত রূপ মাত্র।

বর্তমানে সরকারের একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা হচ্ছে দেশের সব মানুষের জন্য আধুনিক সুবিধা-সংবলিত আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যে জমি ও ঘর দেয়া হচ্ছে, তার নিবন্ধন কারও একক নামে নয়, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের যৌথ নামে জমি নিবন্ধন করে দেয়া হয়েছে। ফলে স্বামী বা স্ত্রী যদি কখনও পৃথক হয়ে যায় তাহলেও জমির মালিকানা হারাবে না। অর্থাৎ এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।

ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের অত্যন্ত দূরদর্শী একটি সামাজিক কার্যক্রম। এই কার্যক্রম নিশ্চিতভাবেই সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করবে।

পিআইডি নিবন্ধ