রফিক মজিদ, শেরপুর: কোটা আন্দোলনের সহিংসতায় নিহত শেরপুরের আসিফুর রহমান নামে ১৭ বছরের এক তরুণের গুলিবিদ্দ হয়ে নিহত হওয়ায় একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চূরমার হয়ে গেছে। কান্না থামছে না তার পরিবারে।
আসিফুর রহমান শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামের আমজাদ হোসেন ও ফজিলা খাতুন দম্পতির ছেলে।
ঢাকার মীরপুরে গত ১৯ জুলাই সহিংসতার ঘটনায় সন্ধ্যা ৬টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওইদিনই রাত ৯টা ৪০মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আসিফ।
পরের দিন ২০ জুলাই ঢাকা থেকে আসিফের মরদেহ নিয়ে এসে জানাজা শেষে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর উপজেলার কেরেঙ্গাপাড়া-ফুলপুর সামাজিক কবরাস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনার পর থেকে ওই পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন ও স্বজনদের কান্নার রোল যেন থামছেই না।
আসিফ গরিব অসহায় পরিবারের ভবিষ্যতে হাল ধরবে বলে বাবা-মা আমায় বুক বাধলেও সেটা আজ শুধু স্বপ্নেই রয়ে গেলো। একটি গুলি আসিফের পরিবারের স্বপ্ন চিরদিনের জন্য শেষ করে দিলো। ছেলের শোকে আসিফের বাবা-মা এখন দিশেহারা হয়ে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন।
নিহত আসিফের মা ফজিলা খাতুন বলেন, আমার ছেলে খুবই ধীর স্থির ও শান্ত স্বভাবের ছিল । স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কুরআনে হাফেজ হওয়ার জন্য পড়াশোনা করতো । তের ছিফারা পর্যন্ত পড়েছে। অভাব অনটনের সংসার তাই ছোট বয়সেই এক বছর আগে ঢাকার মীরপুরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। মাসে সে ১৩ হাজার টাকা বেতন পাইত। ফজিলা খাতুন কান্না জড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, আমার দুই ছেলে। চার মেয়ে। ছেলে মেয়েদের মধ্যে আসিফ দ্বিতীয় । বড় মেয়ের ঢাকায় বিয়ে হয়েছে। ছেলে আসিফ ও তার বাবা ঢাকার মীরপুরে থাকেন। আমি আমার কোলের ৮ মাস বয়সের শিশু ছেলে ও অপর তিন মেয়েকে নিয়ে নালিতাবাড়ী কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামে থাকি। আমার ছেলে আসিফ ছিল আমাদের সম্বল। অকালে তার মৃতুতে আমাদের সব স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। সরকার যদি এখন আমাদের জন্য কিছু করে তা হলে আমার বাঁচার শক্তি পামু। আপনারা দেখেন আমাদের জন্য কিছু করতে পারেন কিনা।
নিহত আসিফুর রহমানের বাবা আমজাদ হোসেন বলেন,আমার ছেলে বয়স কম। সে কোনো রাজনীতি করতো না। আমার সঙ্গে ঢাকায় থাইকা গার্মেন্টসে চাকরি করতো। গত ঈদের আগে সে বেতন ও ঈদ বোনাস মিলিয়ে ১৬ হাজার টাকা পাইছিল। আমি মূর্খ মানুষ আগে মাইনষের দোকানে কাজ করতাম। এক বছর ধরে ধার-কর্জ কইরা মীরপুর-১০ এ আব্বাছ উদ্দিন স্কুলে পেছনে গোডাউন ভাড়া কইরা গার্মেন্টর্স জুটের ব্যবসা শুরু করছি। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর ছেলে আসিফ ও আমি ঘুমাইয়া পড়ি। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঘুম থেকে উইঠা আমার ছেলে আসিফ তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যায়। সন্ধ্যা ৬টা দিকে ছেলে মোবাইল ফোনে বলে বাবা আমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছি।
খবর পেয়ে গুলাগুলির মধ্যেই দৌড়াইয়া যাই। যাইয়া দেহি আমার ছেলে মাথায় ডান পাশে গুলি লাগছে। আহত হয়ে মীরপুরে আলোক হাসপাতালে পইড়া আছে। সেখান থেকে রিকশায় করে ছেলেকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাই। সেখানে ব্যান্ডেজ করে ছেলেকে নিয়ে রিকশায় করে নিউরোসাইন্স হাসপাতালে যাই। সেখানে ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষনা করে। রিকশায় নিউরোসাইন্স হাসপাতালে নেওয়ার পথে ছেলে সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। ছেলে বলে বাবা আমি আর বাঁচবো না। তোমার মনের আশা আমি পূরণ করতে পালাম না।আমাকে মাফ করে দিও। আমজাদ হোসেন বলেন, শুক্রবার রাতেই বাসে করে ঢাকায় যাব। কিছু মালপত্র আছে সেগুলি বিক্রি করতে হবে।
আসিফের ফুফাতো ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, আসিফ আমার মামাতো ভাই। ১৯ জুলাই শুক্রবার ৪/৫ বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে যায়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে মীরপুরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে মোবাইলে ছবি তোলার চেষ্টা করলে মাথায় গুলিবিদ্ধ আহত হয়ে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে মারা যায়। পরের দিন ২০ জুলাই ঢাকা থেকে আসিফের মরদেহ নিয়ে এসে জানাজা শেষে দুপুরে শেরপুরের নালিতাবাড়ীর উপজেলার কেরেঙ্গাপাড়া-ফুলপুর সামাজিক কবরাস্থানে দাফন করা হয়। সে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত না। খুবই সাদাসিদা ও নরম প্রকৃতির ছেলে ছিল সে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম খোকা জানান, ওই ছেলে কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। মীরপুরে গার্মেন্টের্সে চাকরি করতো আর বাবার সঙ্গেই থাকতো। ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় সে গুলিবিদ্দ হয়ে ঢাকাতেই মারা যায়। মরদেহ এলাকায় নিয়ে এসে দাফন করা হলেও আমাকে সে কথা জানানো হয়নি। পরে আমি লোক মুখে শোনেছি। আমার মনে হয় অজানা ভয়ের কারণেই হয়তো আমাকে জানায় নি। তবে তার বাবা-মা আমাদের আওয়ামী লীগের নৌকাতেই ভোট দিত।
নালিতাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল আলম ভুইয়া গুলিবিদ্দ হয়ে নিহত আসিফুর রহমানের মরদেহ দাফনের সত্যতা নিশ্চিত করে এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে জানান, আসিফ কোন রাজনৈতিক দলে সঙ্গে জড়িত নয়। সে গার্মেন্টেসে চাকরি করতো।