Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 9:54 pm

আস্থা ফিরে পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা উল্লম্ফন কাঁচামাল আমদানিতে

শেখ আবু তালেব: আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোযোগ দিতে শুরু করেছেন উদ্যোক্তারা। করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় আশায় বুক বাঁধছেন সবাই। করোনার তীব্র প্রকোপের সময় ধুঁকে ধুঁকে চলতে থাকা কলকারখানায় এখন কর্মীদের সরব উপস্থিতি। এর প্রভাবে হু-হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে কাঁচামালসহ সব ধরনের আমদানি পণ্য।

একসময় নেতিবাচক থাকা এসব আমদানি পণ্যের সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। ঘাটতি পুষিয়ে নিতে উদ্যোক্তারা কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করতে বাড়িয়ে দিয়েছেন আমদানি পণ্যের চাহিদা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা দাবি করেছেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ার গতি ধরে রাখতে দ্রুত গণহারে বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের প্রতিরোধক ক্ষমতা ধরে রাখা যায়।

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় দেশের আমদানি-রপ্তানির চিত্র দেখে। আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য সামগ্রী ও শিল্পের কাঁচামালের এলসি খোলার চিত্র জানান দেয় কেমন চলছে দেশের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি।

এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাল নাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে দুই হাজার ৫৮৩ কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ের চেয়ে ৫১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। শুধু গত অক্টোবর মাসেই আগের মাসের চেয়ে ৬২ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি হয়েছে আমদানি। গত বছরের অক্টোবর মাসে যেখানে আমদানি ছিল ঋণাত্মক ১৭ শতাংশ।

প্রধান আমদানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে ভোগ্যপণ্য, মূলধনি যন্ত্রাংশ, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য, জ্বালানি তেল ও শিল্পের কাঁচামাল। এসব পণ্যর সবগুলোতেই উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. রিজওয়ান রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘উদ্যোক্তারা এখন কিছুটা আস্থা পাচ্ছেন। সবাই বুঝতে পেরেছেন, করোনা নিয়েই বসবাস করতে হবে একটা সময় পর্যন্ত; যতটা সতর্ক হয়ে চলা যায়। এজন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি এসেছে। শিল্পের আমদানি পণ্যের এলসি খোলার হার বেড়েছে। এটি কিন্তু করোনার আঘাতের পর যে জায়গায় নেমে গিয়েছিলাম সেখান থেকে শুরু হয়েছে। এজন্য আমদানি কিছুটা বেশি দেখাচ্ছে। অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক হবে, তখন আমরা বুঝতে পারব কতটা সময় লেগেছে আগের অবস্থায় ফিরে আসতে।’

এজন্য তিনি দাবি করেছেন উদ্যোক্তাদের আস্থা ধরে রাখতে ব্যবস্থা নিতে। পরামর্শ দিয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের এ সভাপতি বলেন, ‘অতি দ্রুত গণহারে বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ যারা টিকা নিয়েছেন, তার কার্যকারিতা শেষ হওয়ার পথে। যারা চলাচল করছেন, তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধরে রাখতে হবে। এটি করতে পারলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে যাবে।’

তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-অক্টোবর সময়ে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের নতুন এলসি খোলা হয়েছে ৩৩৮ কোটি ১৪ লাখ ডলারের ৭২ লাখ ডলারের। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে ২৯ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে নতুন এলসি খোলা হয়েছে, গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল মাত্র ২১০ কোটি ৭২ লাখ ডলারের। এ খাতে গত অর্থবছরের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি অর্ডার করা হয়েছে।

অপরদিকে এই সময়ে আমদানিকৃত পণ্য বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে ২৮৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের, গত অর্থবছরের আলোচিত সময়ে যা ছিল ১৯৪ কোটি ৭২ লাখ ডলারের। পণ্য আসার পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি।

একইভাবে বেড়েছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ ও হার। চলতি অর্থবছরের আলোচিত সময়ে মূলধনি যন্ত্রাংশ আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ২১ দশমিক ২১ শতাংশ। আলোচিত সময়ে ১৮৩ কোটি ১৯ লাখ ডলারের যন্ত্রাংশ আনার জন্য এলসি খোলা হয়েছে। অপরদিকে আগের এলসির মধ্যে যন্ত্রাংশ দেশে এসে পৌঁছেছে ১২৯ কোটি ৪১ লাখ ডলারের।

উৎপাদন শিল্পের চালিকাশক্তি হচ্ছে কাঁচামাল। চলতি অর্থবছরের আলোচিত সময়ে ৯৭০ কোটি ২৭ ডলারের পণ্য আনতে নতুন এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে কাঁচামাল এসেছে ৮৬০ কোটি ৪১ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের চেয়ে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে আলোচিত সময়ে ৪৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

তথ্য বলছে, শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের নতুন এলসি খোলার হার বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। এই সময়ে জ্বালানি তেল আমদানি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। আলোচিত সময়ে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরে ৯০ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়েছে জ্বালানি তেল আমদানি।

কাঁচামাল আমদানির প্রভাব দেখা গেছে রপ্তানি চিত্রেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্পের চাকা সচল হওয়ায় বেড়েছে রপ্তানিও। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩১ দশমিক ২৬ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি চাহিদা বৃদ্ধিতে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকও বাজারে ডলার ছেড়ে  চলছে। গত ১৮ আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে।

এদিকে ডলারের চাহিদা বাড়ায় টাকার সঙ্গে বিনিময় মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে এক টাকা বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রার। টাকার অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। সর্বশেষ প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সা। গত বছরের ডিসেম্বরে এ বিনিময় মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ব্যাংকে ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮৫ টাকা ৭০ পয়সা, ৯ মাস আগে গত জানুয়ারিতেও যা ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। এর বাইরে খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় মূল্য আরও বেশি হয়েছে। বর্তমানে খোলা বাজারে ৯০-৯২ টাকায় ওঠানামা করছে।