ইউনিয়ন পর্যায়ে ডাক্তার পাঠানো নিশ্চিত করতে হবে

শেয়ার বিজ: বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা কেমন দেখছেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: বর্তমান সরকার স্বাস্থ্য খাতের কোনোরকম পরিবর্তন আনতে পারেনি। একটি মাত্র কাজ করেছে, সেটা হলো কমিউনিটি ক্লিনিক। তবে এই কমিউনিটি ক্লিনিকে যেহেতু ডাক্তার নেই, তাই এটি একটি অ্যান্টিবায়োটিক্যাল অপচয় কেন্দ্র হয়ে গেছে। তবে মানুষ ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত লোকাল একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সাক্ষাৎ পায়, এটাই ভালো কথা।

শেয়ার বিজ: তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভালো অবস্থানে নিতে করণীয় কী?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: দেশের ৭০ শতাংশ লোক গ্রামে থাকে। দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ইউনিয়ন আছে। প্রতিটি ইউনিয়নে একটা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা দোতলা ভবন। এতে ৮ থেকে ১২টা রুম আছে। দুর্ভাগ্যবশত এখানে একজন ডাক্তারও থাকে না। ফলে ভবন আছে, কিন্তু কার্যক্রম নেই। অনেক জায়গায় ক্লিনিকের চারদিকে দেয়াল ভেঙে গেছে, এটা মাদক সেবন বা জুয়ার আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। আমি বারে বারে বলছি, অতি সহজে এর উন্নতি করা যায় না। সরকার যদি এসব ক্লিনিকপ্রতি মাত্র ১০ কোটি টাকা খরচ করে, তাহলে উন্নত সেবা দেয়া সম্ভব।

শেয়ার বিজ: প্রক্রিয়াটা তাহলে কী হবে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: একটা ইউনিয়নে গড়পরতা ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোক থাকেন। সেখানে যদি ১০ কোটি টাকা খরচ করে চারজন ডাক্তারের জন্য বাসস্থান, ছাত্রদের জন্য ডরমিটরি, নাসর্দের জন্য বাসস্থান, অপারেশন থিয়েটার, চারিদিকে বাউন্ডারি, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি করা হয়, তাহলে অত্যন্ত আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব হবে। আমেরিকার মতো স্বাস্থ্যকেন্দ্র হবে। এটাতে চিকিৎসকরা কাজ করে আনন্দ পাবেন। এর সঙ্গে এটাও করা দরকার যে, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডিস্ট্রিক্ট থেকে হওয়া উচিত। তা না হলে সে পালাতে পারে। এখন যেমন কাউকে ঢাকা থেকে পাঠায়, সে একবার হাজিরা দিয়েই পালিয়ে যায়; সেটা হবে।

শেয়ার বিজ: এতে কি পুরোপুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: এর সঙ্গে নিয়ম করতে হবে। দুবছর কাজ করার পরে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চিকিৎসক পছন্দমতো একটা ছ’মাসের স্পেশালাইজড কোর্সে আসবে। সেটা সার্জারি, গাইনি, আই বা ইএনটি, অ্যানেস্থেসিয়া, রেডিওলজি, প্যাথলোজি, থাইরোলজি যেকোনোটি হতে পারে। ছয় মাস পড়াশোনা করে পাস করবে এবং সার্টিফায়েড স্পেশালিস্ট হবে। এরপর তাকে ৫০ হাজার টাকা বেতন বাড়িয়ে দেয়া হোক, যেহেতু সে এখন একজন স্পেশালিস্ট হয়েছে।

শেয়ার বিজ: ডাক্তারদের ইউনিয়নমুখী করতে কী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: মেডিকেল ছাত্রদের ইউনিয়ন সেন্টারে পাঠাতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে গ্রামে কাজ করার মনোবৃত্তি জš§ায়। শেষে তাকে লেকচারার করে পাঠাতে হবে। তাকে ছাত্র পড়ানোর জন্য আরও ৫০ হাজার টাকা দাও। বাড়িভাড়া ফ্রি করে দাও। তাহলে দেখা যাবে, ডাক্তাররা অবশ্যই থাকবে।

শেয়ার বিজ: স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে ডাক্তারদের পদ কী হবে?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: তাদের পদ হবে সিনিয়র সেকশন অফিসারের। প্রতি পাঁচজন ডাক্তারের যিনি প্রধান হবেন, তাকে ডেপুটি সেক্রেটারির মতো গাড়ি ও অতিরিক্ত ভাতা দেয়া হোক। তাহলে গ্রামে অবশ্যই ডাক্তার থাকবে। ডাক্তার থাকলে মানুষ সেবা পাবে। আশি শতাংশ লোক ইউনিয়ন পর্যায়ে সেবাটা পাবে। যেটা আমাদের নেই। সেজন্য বলছি, স্বাস্থ্য খাতের কাজটা কঠিন নয়, সরকারের সেটাতে মনোযোগ দরকার।

শেয়ার বিজ: চিকিৎসাব্যবস্থার ব্যয় কমাতে করণীয় কী?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: এত টাকা অপচয় করছি, এক পদ্মা ব্রিজে যত টাকা ব্যয় করেছি, সেখানে আমাদের পাঁচ হাজার ইউনিয়ন সেন্টারের জন্য ১০ কোটি করে ৫০ হাজার কোটি লাগবে। এই টাকা ব্যয় করে সারাদেশের ১৫ কোটি মানুষকে কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যাবে। অথচ এদিকে সরকারের নজর  নেই।

শেয়ার বিজ: স্বাস্থ্য খাতে উন্নত বিশ্বে উন্নয়নগবেষণায় বিশাল বরাদ্দ থাকে আমাদের দেশে এটা বছরে ন্যূনতম কত হওয়া উচিত?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আগে গবেষণা করার দরকার নেই। আগে মূল কাজ সেবাটা দেয়ার অভ্যাস করতে হবে। সরকারি ডাক্তারের যতদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস খোলা থাকবে তত দিন গবেষণা বলে কিছু হবে না। বরাদ্দ বাড়ালে আরেকটু কিছু পয়সা

অপচয় হতে পারে মাত্র। এখনও এটা করা গেল না যে, সরকারি ডাক্তাররা তার নিজের হাসপাতালে বসে বিকালে প্র্যাকটিস করবে। তা করলেও সেবার মানটা বৃদ্ধি হতো। তারা অন্য কাজ করে। বিএসএমএমইউ-তে চাকরি করে সময় দেয় ল্যাব এইডে, বিএসবি হাসপাতালে, স্পেশালাইজড হাসপাতালে।

গবেষণার সময় কোথায় সরকারি হাসপাতালে থাকার কথা চারটা পর্যন্ত। কিন্তু দুইটার পর হাওয়া হয়ে যায়। তারপর সে চারটার পরে বসে প্রাইভেট ক্লিনিকে। সেখানে রাত আটটা, নয়টা, দশটা পর্যন্ত কাজ করে। গবেষণাটা করবে কখন?

শেয়ার বিজ: আমাদের দেশে গবেষণার জন্য বরাদ্দ থাকে কি?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আমাদের দেশে গবেষণার জন্য কিছু বরাদ্দ থাকে। তবে ওই বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহার হয় না। গবেষণা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়ার আগে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডাক্তার পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যেন ডাক্তার সব জায়গায় থাকে। ইউনিয়নের ডাক্তার না পারলে জেলা হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাবে। তাতে গবেষণা করা সহজ হবে। মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের গবেষণা বাধ্যতামূলক করা হোক। কিন্তু ইনারা তো সন্ধ্যার সময় মুদির দোকান খুলে বসে থাকেন। উনাদের সময়টা কোথায়? গবেষণার জন্য মন ও সময় দরকার।

শেয়ার বিজ: ডাক্তার রোগীকে সময় দিতে চান না এক হাজার টাকা ভিজিট নেন, কিন্তু থেকে মিনিট সময় দেন কথা শুনতে চান না একজন ডাক্তারের কত সময় দেয়া প্রয়োজন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আমাদের দেশের ডাক্তাররা বেশি ভিজিট নেন না। এত বছর পড়াশোনা করে এক হাজার ১২শ টাকা ভিজিট বেশি নয়। একটা উকিলের কাছে এক হাজার টাকা নিয়ে গেলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। সুতরাং ডাক্তারের ভিজিট বেশি নয়, তারা ওষুধ কোম্পানির পয়সা খায়, এটা খারাপ কাজ। তারা ডায়ানস্টিক সেন্টার থেকে পয়সা নেয়। সস্তায় ভালো ওষুধ থাকতেও তারা দামি ওষুধ লেখে। ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি হচ্ছে, তা নিয়ে ডাক্তাররা কথা বলে না।

শেয়ার বিজ: ভিজিট বেশি না হলেও সময় কম দেয়, বিষয়ে কী বলবেন?

ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী: তবে রোগীদের অনেক কম সময় দেয়, এটা সত্য কথা। তার কারণ হলো-তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় রোগীর ভিড় হয়। স্পেশালিস্টের কাছে অপ্রয়োজনীয় রোগীর বেশি ভিড় হচ্ছে। রেফারেল ও জেনারেল প্র্যাকটিস থাকলে এরকম হতো না। জেনারেল প্র্যাকটিস বলতে একটি এলাকার লোক একজন ডাক্তারের কাছে নাম লিখিত করবেন। তার কাছে যাবেন। তাকেই দেখাবেন। প্রয়োজন হলে ওই ডাক্তার তাকে স্পেশালিস্টের কাছে পাঠাবেন। উনার টিটি ছাড়া সরাসরি স্পেশালিস্টের কাছে যেতে পারবেন না। আর রেফারেল হলো হাসপাতাল টু হাসপাতাল স্থানান্তর।

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোতে অনেক বিদেশি ছাত্র আছে কিন্তু হাসপাতালগুলোতে বিদেশি রোগী নেই কেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আমাদের দেশে অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বেশি পড়ে না। এটা একটা ভুল কথা। সংখ্যাটা ১০ পার্সেন্টও না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে মেডিকেল শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে। আগে আমাদের ১১০ জন ছাত্র দিতে পারতাম। এখন উনারা আমাদের ৬০ জন করে দিয়েছে। উনারা চান যে, এক জায়গায়ই সব ডাক্তারি শিখতে হবে। আমি বলি গ্রামে যেতে হবে। গ্রামের হাসপাতালে কাজ করতে হবে। এসব উনাদের পছন্দ নয়। এক জায়গায় মেলা হাসপাতাল চান। এসব ভুল কাজের, ভুল সিদ্ধান্তের জন্য চিকিৎসকরা শহরমুখী থাকছেন। গ্রামের দিকে যাচ্ছেন না।

শেয়ার বিজ: বিদেশি রোগী নেই কেন? বিদেশি রোগী আনতে কী প্রয়োজন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আমাদের দেশে বিদেশি রোগী আসবে কী করে? কী জন্য আসবে? আমাদের এখানে বহু স্পেশালিস্ট আছেন, তারা এত বেশি রোগী দেখেন যে, রোগীদের বেশি সময়ও দেন না। এজন্য আমাদের দেশের রোগীদেরই আস্থা নেই। বাইরের দেশের রোগীদের চিকিৎসার কথা না ভেবে আগে নিজের দেশের রোগীদের ঠিকমতো চিকিৎসা করতে হবে।  

শেয়ার বিজ: এদেশ থেকে সবশ্রেণির রোগী বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন এটা কেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: আস্থা নেই। এই যে, চিকিৎসকরা সময় দিচ্ছে না এটা একটা কারণ। তাছাড়া আমি বিদেশি কাপড় পরতে পারব, শাড়ি পরতে পারব, বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারব না কেন? এটা পুঁজিবাদী দেশের পুঁজিবাদের অংশ। সেটা কথা নয়। আমাদের যেটা করা উচিত, তা হলোÑআমাদের দেশের ডাক্তারের প্রতি যেন আস্থা তৈরি হয় সেজন্য কাজ করতে হবে।

শেয়ার বিজ: জাতীয় ওষুধনীতিতে কোনো সংযোজন প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: জাতীয় ওষুধনীতির সঠিক পরিপালনই মূল কাজ। ওষুধ একটা পণ্য, তোমার কোটটা কী জাতীয় চাও, কী রঙ চাও; তুমি ডিসাইড করো। কিন্তু ওষুধের ক্ষেত্রে আমি (চিকিৎসক) করি। ওষুধ কোম্পানিকে পর্যাপ্ত লাভ দিয়ে সরকারকে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটাই ওষুধনীতিতে বলেছিলাম। সালমান এফ রহমানের বুদ্ধিতে খালেদা জিয়া যে ভুল কাজটা করেছিলেন, হাসিনাও ওই সালমানের বুদ্ধিতেই ওষুধের দাম কমাচ্ছে না। এটা না করে কোম্পানির কাছে ছেড়ে দিয়েছে। এটাকে বলে ইনডিকেটিভ প্রাইস। আকাশচুম্বী দাম! একটা ইনজেকশনের দাম এক লাখ টাকাও আছে, এটা কোনো কথা! প্লাটিনামেরও এত দাম নয়! একটা নৈরাজ্য চলছে।