Print Date & Time : 27 July 2025 Sunday 5:40 pm

ইন্টেরিয়র ডিজাইন ‘চারুতা’র ভ্যাট ফাঁকি ৩০ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর নামি ইন্টেরিয়র ডিজাইন চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ৩০ কোটি টাকার বেশি ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়েছে। মাত্র চার বছরে প্রতিষ্ঠানটি এ বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা) ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

মহাপরিচালক বলেন, ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর রাজধানীর গুলশানের একটি ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রায় ৩০ কোটি ৩৬ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় গতকাল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটি হলো চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড (বাড়ি নং-৬৫, রোড নং-২৭, ব্লক-কে, বনানী, ঢাকা ১২১৩); এর মূসক নিবন্ধন নং: ০০২০৩৯৮৪৩-০১০১। ভ্যাট ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকায় ভ্যাট গোয়েন্দার উপপরিচালক ফেরদৌসী মাহবুবের নেতৃত্বে একটি দল প্রতিষ্ঠানটির ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ মেয়াদের কার্যক্রম তদন্ত করে।

ভ্যাট গোয়েন্দার দল তদন্তের স্বার্থে দলিলাদি দাখিলের জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তলব করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দাখিলকৃত বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট), দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জমাকৃত ট্রেজারি চালানের কপি ও অন্য দলিলাদি থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের আড়াআড়ি যাচাই করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।

এই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায়, চারুতা প্রাইভেট লিমিটেড ব্যবসায়িক কার্যক্রম কোড-এস০২৪.০০ হিসেবে নিবন্ধিত হলেও ওই সেবার পাশাপাশি সেবার কোড এস০৫০.১০ অনুসারে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্যের বিনিময়ে বাসভবন, বাণিজ্যিক ভবন, অফিস প্রভৃতির অবকাঠামো নির্মাণের নকশা প্রণয়ন ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যে কোনো অবকাঠামোর ভেতরের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকল্পে ডিজাইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহ করে থাকে।

মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর বিদ্যমান বিধি-বিধান ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রণীত আদেশ অনুযায়ী, আলোচ্য প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় হিসাব পুস্তক (মূসক-১৬), বিক্রয় হিসাব পুস্তক (মূসক-১৭), চলতি হিসাব পুস্তক (মূসক-১৮) রক্ষণাবেক্ষণ ও মাসিক দাখিলপত্র (মূসক-১৯) সংশ্লিষ্ট সার্কেল অফিসে নিয়মিতভাবে জমা প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তা পরিপালন করেনি।

মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর ধারা ৩৭-এর উপধারা (৩) মোতাবেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন আয়ের বিপরীতে ১৭ কোটি ৫১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৭৫ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৩০ কোটি ৯৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপন করেছে। এতে অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৪ টাকার ফাঁকি উদ্ঘাটন করা হয়।

বিভিন্ন আয়ের বিপরীতে প্রযোজ্য এই ফাঁকিকৃত ভ্যাটের ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক দুই শতাংশ হারে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ২২ হাজার ৬৬৯ টাকা সুদ আদায়যোগ্য হবে। বর্ণিত তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি সিএ ফার্ম প্রত্যয়িত বার্ষিক অডিট রিপোর্টে প্রদর্শিত খরচের বিপরীতে উৎসে কর্তিত খাতে কোনো ভ্যাট প্রদান করেনি। কিন্তু এই সময়ে প্রতিষ্ঠানের প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৪২ লাখ ১৭ হাজার ৭৪৩ টাকা।

বিভিন্ন খাতে প্রদর্শিত খরচের বিপরীতে উৎসে কর্তিত খাতে প্রযোজ্য এই ফাঁকিকৃত ভ্যাটের ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে মাসভিত্তিক দুই শতাংশ হারে এক কোটি ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৪৩৮ টাকা সুদ আদায়যোগ্য হবে। বর্ণিত তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ১৪ কোটি ৮৩ লাখ ৯২ হাজার ৪০৬ টাকা এবং সুদ ১৫ কোটি ৫১ লাখ ৯৪ হাজার ১০৭ টাকাসহ ৩০ কোটি ৩৫ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৩ টাকা পরিহারের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে।

তিনি আরও জানান, প্রত্যেক নিবন্ধিত ব্যক্তি করযোগ্য পণ্য সরবরাহ বা করযোগ্য সেবা প্রদান বা পণ্য বা সেবা রপ্তানি বা করযোগ্য আমদানিকৃত পণ্য বিক্রয়কালে বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে একটি সংখ্যানুক্রমিক চালানপত্র প্রদান করবেন। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১-এর আওতায় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে তাদের বিক্রয়কৃত পণ্য ও সেবা বিক্রির বিপরীতে ইস্যুকৃত চালানপত্র উপস্থাপনের অনুরোধ জানানো হলে প্রতিষ্ঠানে বিক্রির বিপরীতে চালানপত্র ইস্যু করা হয় না বলে তদন্ত দলকে তারা অবহিত করে।

প্রতিষ্ঠানের বিক্রির বিপরীতে চালানপত্র ইস্যুর সুস্পষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও মূসক ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ তা পরিপালন করে না বলে দেখা যায়। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ মূসক ফাঁকির উদ্দেশ্যে স্থানীয় মূসক কার্যালয়ে (সার্কেল অফিস) প্রতি কর মেয়াদে (মাসে) দাখিলকৃত দাখিলপত্রে পণ্য বা সেবা বিক্রির কোনো তথ্য উল্লেখ না করেই দাখিলপত্র জমা দিয়েছে। ভ্যাট ফাঁকি ও নানা অনিয়মের অভিযোগে ভ্যাট আইনে গতকাল এ-সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তদন্তে উদ্ঘাটিত ভ্যাট ফাঁকির টাকা আদায়ের আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের জন্য মামলাটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হবে। মামলাটির ন্যায় নির্ণয়নে অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাবি করা ভ্যাট ফাঁকির টাকার অতিরিক্ত দ্বিগুণ পরিমাণ জরিমানা হতে পারে বলে জানান ড. মইনুল খান।