Print Date & Time : 6 August 2025 Wednesday 4:21 am

ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলার খবরে আতঙ্কিত গ্রাহকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাকের ফুলঝুরি সাজিয়ে ই-কমার্স ব্যবসায় আসা আলোচিত-সমালোচিত কোম্পানি ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আর এ খবরে ইতোমধ্যে ক্রয়াদেশ দেয়া পণ্য বা তার বিপরীতে পরিশোধ করা অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে অগ্রিম নেয়া ৩৩৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে সরিয়ে ফেলার আশঙ্কায় ইভ্যালির বিরুদ্ধে মামলা করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ইভ্যালির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাওয়া আর্থিক অনিয়মগুলো তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) পৃথক চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এছাড়া গ্রাহকদের কাছ থেকে ২১৪ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণ করে পণ্য সরবরাহ না দেয়া ও মার্চেন্টদের ১৯০ কোটি টাকা পাওনা ফেরত দেয়ার বিষয়ে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ইভ্যালির মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম বাবদ ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং মার্চেন্টদের কাছ থেকে ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকার মালামাল বাকিতে গ্রহণের পর স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে কমপক্ষে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা।

গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছে ইভ্যালির দায়ের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে জানায়, এ কারণে ইভ্যালি কর্তৃপক্ষ কোম্পানির রেপ্লিকা ডেটাবেজে পরিদর্শন দলকে ঢুকতে দেয়নি।

গত ৪ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক, ভোক্তা অধিকার ও প্রতিযোগিতা কমিশনে পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ইভ্যালি ডটকমের চলতি সম্পদ দিয়ে মাত্র ১৬ দশমিক ১৪ শতাংশ গ্রাহককে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বা অর্থ ফেরত দিতে পারবে। বাকি গ্রাহক এবং মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করা ওই কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কাছ থেকে নেয়া ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকার কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না, যা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

গ্রাহকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা ও মার্চেন্টদের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়ার অর্থ আত্মসাৎ বা মানি লন্ডারিং কিংবা অন্য কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়েছে কি না, তা তদন্ত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকে অনুরোধ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

যেসব গ্রাহক অগ্রিম টাকা দিয়ে পণ্য পাননি এবং মূল্য ফেরত পাচ্ছেন না, তাদের অধিকার সুরক্ষা করতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির আইনে ভোক্তা স্বার্থ লঙ্ঘনের দায়ে কোনো কোম্পানি বন্ধ করে দেয়ার বিধানও রয়েছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মামলার সুপারিশ করার পর আতঙ্কে আছেন ইভ্যালির গ্রাহকরা। ইভ্যালির বিভিন্ন সময়ের সুপার সাইক্লোন, সাইক্লোন অফার, ডিসকাউন্ট অফারে পণ্য ক্রয়ের আদেশ দেয়ার পরে এখনও পণ্য হাতে পাননি ক্রেতারা। এরই মধ্যে মামলার সুপারিশের কথা শুনে পণ্যের টাকা পরিশোধ করা গ্রাহকরা তাদের পণ্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

ফেব্রুয়ারির সাইক্লোন অফারে আর ১৫ ব্র?্যান্ডের মোটরসাইকেল অর্ধেক দামে পেয়ে ইভ্যালিতে দাম পরিশোধ করেন লুৎফর রহমান নামের এক গ্রাহক। ইতোমধ্যে পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও পাননি তার পণ্য। লুৎফর বলেন, ‘৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে পণ্য সরবরাহের কথা বলা হলেও পাঁচ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও তা হাতে পাইনি। বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করা হলে শুধু আশ্বাসই পেয়েছি, কিন্তু পণ্য পাইনি। এখন যে অবস্থা, তাতে আমার বাইক পাওয়া তো দূরের কথা, টাকা ফেরত পাব কি না, তা নিয়েই শঙ্কিত আমি।’

প্রকৌশলী হুজাইফা ফেব্রুয়ারি মাসে গরমের কথা বিবেচনা করে এসির অর্ডার করেন। টাকা পরিশোধের পরে নির্ধারিত সময় অনেক আগে অতিক্রম করলেও পণ্য বুঝে পাননি তিনি। হুজাইফা বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে গরমের সময়ে একটা এসি কেনার কথা চিন্তা করেছি। এবার ইভ্যালিতে ডিসকাউন্ট অফার দেখে আমিও অর্ডার করে ফেলি। কিন্তু এখন গ্রীষ্ম শেষ হয়ে আবার শীত চলে আসছে। কিন্তু আমার পণ্য এখনও পাইনি।’

এরকম আরও অনেকের অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ফেসবুকে কোনো পোস্ট দেয়া হলেই তার নিচে অসংখ্য মন্তব্য আসে পণ্য না পাওয়ার ব্যাপারে। সেসব মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে ইভ্যালির পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়, বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করা হবে। কিন্তু দিনের পর দিন এসব উত্তরের পরে আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায় না বলে জানান একাধিক গ্রাহক।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাবুল কুমার সাহা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। আমরা তার কিছু সমাধান করেছি, কিছু করছি। এবার যেহেতু মন্ত্রণালয় সুপারিশ করেছে তাই এই ব্যাপারটা এখন আর সাধারণ অভিযোগের পর্যায়ে নেই। আমরা এখন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’

এর আগে ই-কমার্স থেকে পণ্য কেনাকাটায় অগ্রিম মূল্য পরিশোধের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ই-কমার্স বিষয়ক বহুপক্ষীয় বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ই-কমার্স থেকে কেনাকাটার ক্ষেত্রে গ্রাহক পণ্য বুঝে পাওয়ার পর বিক্রেতা মূল্য পাবেন বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান।

তিনি জানান, গ্রাহক পণ্য বুঝে পাওয়ার পর ডেলিভারি মেসেজ দিলে বিক্রেতা মূল্য পাবেন। আর এ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গেটওয়ের মাধ্যমে এ অর্থ লেনদেন হবে। তবে তার পরামর্শ, গ্রাহকরা যেন ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড, বিকাশ বা নগদের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে কেনাকাটা করেন। তারা যেন আগাম নগদ অর্থ পরিশোধ না করেন।

ইভ্যালি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা বিপুল ছাড় দিয়ে লোকসানে পণ্য বিক্রি করছে। এ কারণে দেশের ই-কমার্স ব্যবসায় অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে ভালো ও সৎ ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং ভবিষ্যতে এ খাতের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হবে।

এদিকে ইভ্যালি ও আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্সের সঙ্গে ক্রেডিট, ডেবিট ও প্রি-পেইড কার্ডের লেনদেন বন্ধ করেছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে এর গ্রাহকদের সতর্কবার্তায় তারা জানায়, কার্ড দিয়ে ই-কমার্স ট্রানজেকশনে অনলাইন মার্চেন্টের সঙ্গে লেনদেন-সংক্রান্ত বিরোধের জন্য ব্যাংক দায়ী থাকবে না। গত ২২ জুন ব্র্যাক ব্যাংক ইভ্যালি ও আলেশা মার্টসহ ১০টি ই-কমার্সের সঙ্গে লেনদেন স্থগিত করে। এরপরই ব্র্যাক ও ঢাকা ব্যাংক লেনদেন স্থগিতের বার্তা পাঠায় গ্রাহকের কাছে।