ইরান-আজারবাইজান বিরোধ নিরসনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে

আতিকুর রহমান: সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দু’দেশের সম্পর্ক এখন এতই খারাপ যে তারা পরস্পরের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। ইরানের চিরশত্রু ইসরাইলের সঙ্গে শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে আজারবাইজান। অন্যদিকে আজারবাইজানের চিরশত্রু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের শক্তিশালী সামরিক বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

অথচ মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইরান এবং ইরাকের পরে শিয়া মুসলিমদের সবচেয়ে বেশি বসবাস আজারবাইজানে। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ শিয়া মুসলিম। অর্থাৎ এত বড় শিয়া জনগোষ্ঠীর দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিয়া মতাদর্শ প্রচারে মরিয়া ইরানের সঙ্গে তার সম্পর্ক তলানিতে।

দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের সম্পর্ক অবনতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণ বিরাজমান থাকলেও সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে আজারবাইজান থেকে ইরানের ৪ কূটনীতিককে বহিষ্কার ও দক্ষিণ আর্মেনিয়ার নাখচিভানে আজারবাইজানের করিডর নির্মাণের চেষ্টা।

গত ২৭ জানুয়ারি তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে সশস্ত্র হামলার পর এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। এরপর, আজারবাইজান তেহরানে দূতাবাস বন্ধ করে দেয় এবং সব কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়, পাশাপাশি আজারবাইজানিদের ইরান ভ্রমণে সতর্ক করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজারবাইজানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ৬ এপ্রিল ৪ ইরানি কূটনীতিককে বাকু থেকে বহিষ্কার করে তাদের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আজারবাইজান ত্যাগ করতে বলা হয়। ইরান একে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছে এবং তারা পাল্টা কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছে। এমতাবস্থায় অনেকেই আশঙ্কা করছে উভয় দেশের এ উত্তেজনা সামরিক সংঘাতে রূপ নেয় কিনা!

ঐতিহাসিকভাবে ইরানের সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্ক এত খারাপ ছিল না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পরপরই ইরান আজারবাইজানকে স্বীকৃতি দেয় এবং আজারবাইজানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।

তবে পরের বছর থেকেই উভয় দেশের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।  নাগোর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজেরিদের সঙ্গে আর্মেনীয়দের ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। সে যুদ্ধ চলাকালীন ইরানের মধ্যস্থতায় ১৯৯২ সালে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তির কিছুদিন পরেই আর্মেনীয় সেনাবাহিনী আজারবাইজানের খোজালি অঞ্চলে আক্রমণ করে গণহত্যা চালায়। সে বছরই আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আবদুল ফাজ এলচিবেই। তিনি ছিলেন কট্টর ইরানবিরোধী। ইরানের পরিবর্তে তুরস্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তিনি আজেরিদের তুর্কি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। ইরানের সীমানার মধ্যে থাকা দক্ষিণ আজারবাইজান অঞ্চলকে দখল করে আজারবাইজানের অংশ বানানোরও ঘোষণা দেন। আর তখন থেকেই ইরান আজারবাইজানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং আজারবাইজানের শত্রু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে।  শুরু হয় ইরান-আজারবাইজান স্নায়ু যুদ্ধের।

ইরান আস্তে আস্তে আর্মেনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করে। অন্যদিকে আজারবাইজান ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করে। ইসরাইল থেকে প্রচুর সামরিক সরঞ্জাম কিনে। অন্যদিকে ইরানকে চাপে রাখতে বিভিন্ন সময় ইরানে বসবাসরত আজেরি তুর্কিদের মদদ দেয়ার অভিযোগও আছে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে। ইরান মনে করে আজারবাইজান যত শক্তিশালী হবে এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব ততই হুমকির মুখে পড়বে।

সম্প্র্রতি আজারবাইজান অভিযোগ করেছে ইরান তাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নাখচিভান ছিটমহলে সেনা সমাবেশ করেছে। এই অভিযোগ তেহরান সরাসরি অস্বীকার করেনি। ইরানি ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ড কোরের আল কুদস বাহিনী ইরান-আজারবাইজান সীমান্তের কাছাকাছি ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে আজারবাইজান আরও অভিযোগ করে।

এদিকে নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে আজারবাইজান নাখচিভানে একটি স্থল করিডর নির্মাণ করতে চায়। তবে এ করিডর নির্মাণ করা হলে তা আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ইরানের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ ধরনের কোনো করিডর তারা আজারবাইজানকে নির্মাণ করতে দেবে না। কেননা এর প্রভাবে দক্ষিণ ককেশাসে ইরানের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তা ইরানের অস্তিত্ব হুমকিতে ফেলবে। ইরানের উত্তর দিক তুর্কি জাতি গোষ্ঠী অধ্যুষিত দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত ইরানের আশঙ্কা ভবিষ্যতে ইরানের ওপর আক্রমণ করার জন্য আজারবাইজান তাদের ভূখণ্ড ইসরাইলকে ব্যবহার করতে দিতে পারে।

পাশাপাশি তুরস্কের সঙ্গে আজারবাইজানের সম্পর্কও মেনে নিতে পারেনি ইরান। কারাবাখ যুদ্ধের পরে তুরস্ক থেকে আজারবাইজানে পৌঁছতে আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে একটা করিডোর করার চুক্তি হয়। এতে করে তুরস্ক ইরানকে বাইপাস করে সরাসরি পৌঁছতে পারবে আজারবাইজান ও মধ্য এশিয়ায়। এছাড়া গত বছর জুন মাসে তুরস্ক ও আজারবাইজান ঘোষণা করে শুশা ডিক্লারেশন। সে অনুযায়ী এই দুই দেশের কোনো ১টায় তৃতীয় কোনো দেশ থেকে আক্রমণ এলে একে অপরকে সরাসরি সামরিক সহযোগিতা দেবে এবং এ দুই দেশের সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণ করতে একে অপরের সঙ্গে কাজ করবে। এছাড়া তুরস্কের সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আজারবাইজানে একটা সামরিক শিল্প গড়ে তুলছে। এ শুশা চুক্তি ইরান এবং আর্মেনিয়ার জন্য কারাবাখ যুদ্ধের চেয়েও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে  ইসরাইলের সঙ্গে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলাকে ইরান তার নিজের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছে। ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইরান আজারবাইজানকে বারবার সতর্ক করলেও কিন্তু আজারবাইজান কর্ণপাত করেনি। তেলসমৃদ্ধ আজারবাইজান ইসরাইলে অন্যতম শীর্ষ তেল সরবরাহকারী দেশ। সেই তেল বেচা অর্থ দিয়ে আজারবাইজান ইসরাইল থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনসহ অন্যান্য অস্ত্র কেনে, যা নাগোর্নো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে আজারবাইজান শত্রু আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে।

আজারবাইজানের দূতাবাসে হামলার কয়েক সপ্তাহ আগে আজারবাইজানের পার্লামেন্ট ইসরাইলে দূতাবাস খোলার বিল পাস করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত মাসে আজারবাইজান সরকার প্রথমবারের মতো ইসরাইলে তাদের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয় ও দূতাবাস চালু করে। পরে উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তেলআবিবে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরানবিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তোলেন। বাকুর এই সিদ্ধান্তকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে তেহরান।

ইরান ইতোমধ্যে আজারবাইজানকে সীমান্তে একটি ইহুদিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছে। ইরানের পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ও রাজনীতিবিদরা আজারবাইজানের নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী আজারবাইজানের এসব কর্মকাণ্ডকে ফিলিস্তিনিদের রক্ত ঝরানো রাষ্ট্র ইসরাইলের সহযোগী শক্তি হিসেবেই বিবেচনা করবে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার পর ইসরাইল আজারবাইজানের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ ছিল।

ইতোমধ্যে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড ও সেনাবাহিনী আজারবাইজান সীমান্তের কাছে কয়েক দফা উচ্চপর্যায়ের মহড়া করেছে। মহড়ায় সেনা ও বিমানবাহিনীর দক্ষতা প্রদর্শন করা হয়। গত অক্টোবরে বিপ্লবী গার্ড আজারবাইজান ও ইরান সীমান্তে আরাস নদীতে অস্থায়ী সেতু তৈরি করে বাকুকে কঠিন বার্তা দেয়। অপরদিকে আজারবাইজানও তুরস্ক, পাকিস্তানকে নিয়ে বিশাল সামরিক মহড়ার আয়োজন করে।

এমন পরিস্থিতিতে ইরান-আজারবাইজান সামরিক সংঘাতে জড়াবে কি না বা ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে; তা নিয়ে বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করছেন।

বিশ্লেষকের ভাষ্যমতে, গত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা তেহরান-বাকু উত্তেজনা পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেও তা সামরিক সংঘাতের দিকে নাও যেতে পারে। কেননা, আজারবাইজানের দূরবর্তী নাখচিভান প্রদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দেশটিকে ইরানের ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া ও তুরস্ক প্রতিবেশী ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। এছাড়া, ইরানের সঙ্গে ‘চির প্রতিদ্বন্দ্বী’ সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চীন মধ্যস্থতা করছে। ইরান-আজারবাইজান যুদ্ধ বাধলেও তারা নিশ্চয় মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসবে। তবে আশার খবর, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ান ও আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেয়হুন বৈরামভ দুই দেশের মধ্যে ‘ভুল বোঝাবুঝি ও সমস্যা’ দূর করতে ইতোমধ্যে ফোনালাপ করেছেন।

অনেকে বলছেন, ইরান ও আজারবাইজান যেভাবে নিজেদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে চলছে তা হয়তো সামরিক সংঘাতের দিকে গেলেও যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইরান সরকারের আশঙ্কা দেশটির ক্ষতি করতে সদা প্রস্তুত ইসরাইলের প্ররোচনায় আজারবাইজান ইরানের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়াতে পারে। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ১৯৮০ সালে  পশ্চিমাদের প্ররোচনায় ইরানে প্রতিবেশী ইরাকের আকস্মিক আক্রমণ, যা দীর্ঘ ৮ বছর অব্যাহত ছিল।

শিক্ষার্থী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়