শেয়ার বিজ ডেস্ক : মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত ও উত্তেজনার ফলে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে তেলের দামে অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় অচলাবস্থা। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতো আমদানিনির্ভর অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধের প্রভাবে তেলের দাম বেড়ে যাওয়া, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটে বিঘ্ন সৃষ্টি এবং মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক রেমিট্যান্স প্রবাহে সম্ভাব্য বিপর্যয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির গতিপথকে বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় ফেলে দিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি একদিকে রপ্তানিনির্ভর, অন্যদিকে জ্বালানি আমদানিনির্ভর। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ও হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের রুট ব্যাহত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক বিপর্যয় নেমে আসবে।’
তিনি উল্লেখ করেন, ‘বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বেড়ে গেলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাবে, রপ্তানির প্রতিযোগিতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হবে।’
বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যেটি দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশেরও বেশি জোগান দেয়, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে চাহিদা ও জাহাজ চলাচলের রুট স্বাভাবিক না থাকলে রপ্তানি সময়মতো পৌঁছানো কঠিন হবে। এতে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস হুমকির মুখে পড়বে।
অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, তেল সরবরাহে এখনই বড় বাধার আশঙ্কা নেই। তবে এলএনজি সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়লে আমাদের বিকল্প উৎস না থাকায় চাপ বাড়বে।
ইতোমধ্যে ব্রেন্ট ক্রুড ও ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘হরমুজ প্রণালি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৯০ থেকে ১২০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে।’
সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তেলের দাম শুধু একটি পণ্যের মূল্য নয়, এটি হলো বিশ্ববাজারে দামের ব্যারোমিটার। দাম বাড়লেই দেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বেড়ে যাবে, পরিবারগুলোর খরচের সক্ষমতা কমবে এবং আয়-ব্যয় ভারসাম্য নষ্ট হবে।’
লোহিত সাগর এলাকায় হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে ইউরোপমুখী জাহাজ চলাচল ইতোমধ্যে ব্যাহত হয়েছে। এতে বৈশ্বিকভাবে শিপিং খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। সংঘাত দীর্ঘ হলে এই চাপ আরও বাড়বে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্প যেহেতু সময়ানুযায়ী ও সাশ্রয়ী পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল, তাই বাড়তি শিপিং খরচ এই খাতের প্রতিযোগিতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ ছাড়া আকাশপথে মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ হলে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের খরচও বহুগুণ বেড়ে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পরিবহন খাতে নতুন জটিলতা তৈরি হবে।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়ের বড় একটি অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। যদিও সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে এবং রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি খুবই অনিশ্চিত।
ড. রায়হান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হলে প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরি ও উপার্জন ঝুঁকিতে পড়বে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নতুন চাপ তৈরি করবে।’ এ ছাড়া আমদানি ব্যয় যদি বেড়েই যায়, তবে এই রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস পাবে, ফলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে সরকারকে দ্রুত একটি কার্যকর সংকট ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে-বিকল্প জ্বালানি উৎস উন্নয়ন, বাণিজ্য রুটের বিকল্প খুঁজে বের করা, তৈরি পোশাক খাতকে পরিকল্পিত সহায়তা দেয়া ও উচ্চমূল্য ও সরবরাহ জট মোকাবিলায় প্রণোদনা প্যাকেজ তৈরি।
তারা সতর্ক করে বলেন, ‘ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে এর অভিঘাত শুধু জ্বালানি বা বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি এবং জনজীবনের সামগ্রিক ব্যয়ভারকে প্রভাবিত করবে।’